Thursday, December 04, 2014

আঘ্রাণের অনুভূতিমালা



পৌষ নতুন ধানের গন্ধ আনে না বরং গান্ধির হাজারি গন্ধের গোলাপি আলোয় আমরা পোড়াই রাত্রির মনোবাঞ্ছা সদ্য পড়া কুয়াশায়। আমি শহরে থাকি। মাথার মধ্যে থ্যালামাস আর চুল শিরা গলি ওয়ানওয়ে আর বাইপাস। রাত বাড়লে যদ্যপী দাপাদাপি আর কী সব করে জীবন কাটাই সেই বুঝিবা ট্রাফিক সিগন্যালের সা-রে-গা-মা আলোকসূচকগুলি। এর পরে কী করে আর বোঝাই আঘ্রাণের কথা। সে সরে সরে যায় নীরবে দূরে। আলোকঝঞ্ঝায়, পশ্চাতে ধায়, হায় হায় রে, সুন্দরী মলুয়া ডুবে যাচ্ছে নদীতে, মলুয়ে হায় হায় রে। উত্তর দিনাজপুরের একটি ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলে দৈবাৎ, মনে হয় পায়েস রান্না হচ্ছে অনন্তের পাকশালে। ধান পাকতে শুরু করেছে। কৃষকেরা কাজে। আমার সঙ্গে ছিলেন দেবাশিস বাবু। তিনি ওই অঞ্চলের লোক নন। শান্তিনিকেতনী প্রভাবে নুব্জ, ধান বলতে, বাসমতি, আহা, উচ্চারণেই তার চোখ ও মুখ উদ্ভাসিত হয়। আমার নাক তবু বুঝি জেগে আছে আজও, এইরকম ফাৎনাবৎ। আমি ধান থেকে ধ্যানে চলে গেছি। সেই চালটির নাম ছিল চিনি আতপ। সুগন্ধ পরিসরে ছড়ায় জ্যামিতির মত। সেই যাত্রায় কিনেও আনি কিছু কেজি রায়গঞ্জের চাউলপট্টি থেকে। তার পর আবার কোনও মেলায়, আবার। বাংলাদেশের পোলাও এর চাল বলে কিনতাম ভারী নিপুন দেখতে চিনিগুড়া তার সঙ্গে কোনও মিল নেই বহিরাঙ্গে। এর আলাপ ও বিস্তার অন্যত্র, সে গন্ধে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে, এই চাল শ্রীরাধিকার মত।




বাংলাদেশে থাকতে আমার রোজগার খাওয়ার জন্য কিনতাম যে দেশি চাল তার নাম বাঁশফুল। ঘোলাটে রঙের অসচ্ছ চাল। ঢেঁকি ছাটা না হলে পেপার হোয়াইট। তাতে জল ঢালে ও ধোয় জীবানানন্দের কোন কিশোরী হাত, এমনটাই ভ্রমে আমার অনেক সন্ধ্যে কেটেছে। বেটে বেটে চালগুলিতে জল ঢালতেই তদের চেহারা বেলফুলের মত হয়ে যেত, রান্ধলে মুক্তা। গুরুপাক খাওয়ার জন্য কিনতাম কালোজিরা চাল। চিনিগুড়ার থেকে আমার বেশি পছন্দ এই চাল হ্যাঁ গন্ধের কারণেই। বিন্নি এলে রান্না ঘর এমনিতেই আলো হয়ে যেত। সাদা বিন্নি আসত চট্টগ্রাম থেকে। লাল বা কালো কেনা হত প্রবর্তনা থেকে। আমি নিজে যেতাম না, তিলক বিশ্বাস বা তামান্না নিয়ে আসত। চালটা দেখতে ঘুবই ঘোলা, যেন একরাশ কাঁকর, একটা চালও বুঝি গোটা পাওয়া যেত না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা। তার সুবাসে কেবল কাব্যই হয় সুতরাং বিরত থাকলাম এই যাত্রা তার রূপকথায়। বিরিয়ানীর জন্যে রাইফেল স্কোয়ারের সেনাবাহিনীর দোকান থেকে আনা হত দিনাজপুরের চন্দনচূড় আর কনকচূড়। মেলা দাম, লোকজন বিশেষ কিনত না- সপ্তাহে দুই একজন খরিদ্দার, পরে জানলাম দোকানটাই উঠে গেছে। এইসব চাষ-বাষ সবই উঠব উঠব করছে। বন্ধু-বান্ধব যারা খেয়েছে তারা প্রসংশা করলেও নিজেরা আর বুঝি কিনে খায়নি, মাংসতেই তারা অধিক আগ্রিহী হয়ে থাকবে বিরিয়ানী প্রযোজনায়। দুটি চাল জ্বালে দিলেই দুধ হয়ে বেরোত, সে অপার্থিব সুগন্ধের রাজ্যপাট। আমি জানিনা ইলিশ বিরিয়ানীর জন্য এই চন্দনচূড় চালের কোন বিকল্প ফটোশপ বাদে অন্যত্র থাকবে কিনা।




কেউ কেউ চাল নিয়ে আসে। গান খুঁজতে গিয়ে বাপ্পাদা নিয়ে এলো কালানুনিয়া আর চালওয়ালার ফোননম্বর। যাওয়ার আগে যেন বলে যাই, সে রেডি করে রাখবে। সরসমেলা থেকে আসে তুলাইপঞ্জি। ডিয়ার ডিএ র জয়ন্তবাবুর ফোন নম্বর দেয় এক বালুরঘাটের লোকশিল্পী। কুড়ি পঁচিশ যা লাগবে জানিয়ে গেলে ভাল। বেশি তো কেনা যায় না, রাখাই যায় না এইসব সুগন্ধি চাল। পিঁপড়ে থেকে পোকা সবই লেগে থাকে পাপক্ষয়ের মত। আমার অসম বয়সের এক বন্ধু শ্যামল বসুমাতারি আমার ধান-চাল নিয়ে উৎসাহ আছে জেনে টানা আট-দশ ঘন্টা আমায় বিচ্ছিরি রাস্তায় বাইকের পেছনে নিয়ে চাল দেখিয়ে বেরিয়ে ছিলেন বছর দুই-তিন আগে। চলতে চলতে আলিপুরদুয়ারে জয়ন্তি পেরিয়ে কামাক্ষ্যাগুড়ির কাছে দেখা পেয়েছিলাম স্বর্ণমস্রি আর কালাননিয়ার। সেই যাকে বলে ধান্যক্ষেত্র, বিজন ভট্টাচার্ষের মত বললেন শ্যামলদা। একমাত্র ছেলে মারা গেছে বছর পাঁচ বাইক দুর্ঘটনায়। তার বাড়িতে আমার সর্বক্ষণের দাওয়াত। কালানুনিয়া খাইবা শুকর দিয়া আর শুয়ে থাকবা ঘরত, গান-বাজনায় কাটাবা জীবনটা। কোনওবার ২৫ ডিসেম্বরের যা বাজা্রের বহর থাকে, তা শুনেই আমি স্তম্ভিত, ফোন করি ডিসেম্বরের শুরুতেই, আয়োজন সব ঠিক আছে তো। খান তিন শুয়োর- যা তিনবাড়ির লোকে সাতদিনে খেয়েও নাকি শেষ করা যায় না! আর আছে ডানা মেলা পক্ষীরাজ বা পিপলিভাঙ্গ ধান যা নাকি ফলতেই চায় না জমিতে- কসরতের বর্ণণা শুনি, হাসি লুকিয়ে। তা সমৃত সুলভ ভাত কেবল খাওয়া হয় এই পরবের দিনগুলোয়। আমার আর যাওয়া হয় না বছরশেষের উৎসবে। কলকাতায় বসেই গন্ধ পাই বিশ্রুত নামের প্রায় নেই হয়ে যাওয়া এই সব ধানের। ভাত ফোটার গন্ধ পাই মেঘে ঢাকা তারার নিশ্চুপ আকাশে। কেউ আলিপুরদুয়ারে যাচ্ছে শুনলেই তাকে দিয়ে দিই শ্যামলদার মোবাইল নম্বর। বারেবারে বলি একটিবার যেও। শ্যামল দাকেও ফোন দিই। তিনি চালের প্যাকেট করে দিন গোনেন, বন্ধুর বাড়ি মেলা দূর, এই শহর কলকাত্তা, যেখানে পৌষ কোন গন্ধ নিয়ে আসে না। কেউ তাকে ফোন দেয় না। যে যার মত ফিরে আসে বেড়িয়ে। হাতি গাছ-পালা বাইসন রাম-হুইস্কি নিয়ে উচ্ছ্বসিত কতগুলি সন্ধ্যা কেটে যায় আমার ক্লেদের শহরে।