Thursday, December 04, 2014

পৃথিবীর সব গান নিভে গেলে তবু কিছু আলো গান হয়ে ওঠে

তুমি মৃত্যুকে প্রশ্ন কর। হাতি প্রশ্ন করে, আলপিনও। একগাদা কেবল প্রশ্ন পড়ে থাকে, পাহাড়ের মত, আমুন্ডসেন সেখানে ফ্ল্যাগ ওড়ান। চাঁদ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। মাটির জল নিয়েও। প্রশ্নের মুন্ড-মাথা হাত পা গজায় এই ভাবে, সেও ঘুরে বেড়ায় রাজপথে। মানুষের মত। সেও অস্থির। আজ লোকাল ট্রেনে, তো কাল লক-আপে। সে দিন ও রাতের ভেতর, ট্রামের তারাবাজির ভেতর মেজরাপের মত অস্থির। কলাপাতার উপর ধুলো আঠালো হয়ে বসে, শার্টের কলারে বিষাদের দাগ, উল্টাতে না পারা আরশোলার মত, এই থেঁতলে দিলে তুমি- প্রশ্নদের। বাস্তব। বা আকাশে উড়িছে বকপাখি- রবিঠাকুর এখন সাদা ধোঁয়ার মত এক গান- অবয়বহীন- ইস্কুলবালিকা বৃষ্টির ভেতর দিয়ে গেলে তিনি ঘুরেও তাকাতেন না। এখন তোমার নখের ভেতর মৃত্যু। নীল আঙ্গুলে কাঁচ মুচ্ছ ট্যাক্সির জানালার। বট পাতা ভেঙ্গে তার সাদা আঠা বেয়ে উঠছে তোমার আঙ্গুলে, সেই হয়ে উঠেছে তোমার আই-লাইনার, তুমি সেজে উঠছ আলতায়, কেমন যেন তোমার জ্বীভে নীল দোয়াতের কালি- ছেলেবালার পায়েসের স্বাদ।  দ্যেলুজের প্রথম খন্ডের মত একটা মেঘ সাদা হয়ে আছে মেঘলা জানালায়, চোখ মেঘের মত বড় হচ্ছে বা হ্রদের মত, রেটিনা ক্রমশ ফুলতে ফুলতে উৎলে পড়ল দুধের মত। কালিদাস আওড়াচ্ছেন রঘুবংশম- খুব স্লো। কোন খোলা চুল ওইশ্বর্য রাই, ইষৎ ফ্যাট সমেত, তরুনী ইঞ্জিনিয়ার সীতার ব্যস্ততায় নেমে যাচ্ছে পাতালে, সম্প্রসারিত হচ্ছে মেট্রো- আর সেটা জ্যাকসেওনের মস্কোর মত স্লো।  তুমি মৃত্যুকে প্রশ্ন কর, থেমে থেমে- লিটার, মিটার, ফুট। সব বাড়তি, পাতা উড়ছে, হাওয়া বাড়তি, কাজেই সব প্রবল লাগছে এখন তোমার, ছাপাখানার শব্দে অসম্ভব গতি। মেগাস্থেনিসের বাড়তি যে সব নোট একদিন ইন্ডিকা হয়ে গেল- ঘাড় নাড়ছেন রোমিলা থাপার, আরকিমিডিস প্লবতা দেখাতে চৌবাচ্চায় ছুঁড়ে ফেলছেন চন্দ্রগুপ্তের মুকুট। বৌদ্ধ শ্রমণ যে পথে যান, সেই পথে ফেরেন না, ঘুরপথে এই নাকতলা, ওই কানপুর- কথাও মিনিবাস-গুগুল ম্যাপ-ক্লাস ফাইভের ভুগোল ক্লাসে ম্যাপ পয়েন্টিং, আমাদের পেকে যাওয়া চুলগুলি লুপ্তপ্রায় যৌবনের আশেপাশে কে যেন বসিয়ে দিচ্ছে জোর করে, সম্ভবত ইনিই ক্লদ মানে। হে উৎকীর্ণ শিলালিপি, হে ভালবাসার শহীদ কতিপয় স্তম্ভ, আমাদের প্রেমের গোরস্থানে ক্রমাগত উপগত পাতারা, হে পাথরের জন্ম-মৃত্যু লেখা রঙচটা এলিজি, শোনো হে স্বর্ণসীতা, আদিবাসী কিশোরী পদাঘাত না করলে অশোক গাছে ফুল ফোটে না, তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এমনটাই লোকশ্রুতি।

একদিন এক ট্রেন মৃত্যুকে প্রশ্ন করল। একদিন দক্ষিণের হাওয়া। একদিন এক দোয়াত কালি। একদিন উপলক্ষ্য। আলো এলো অদল-বদলের খেলা নিয়ে। জীবনানন্দ শুয়ে রইলেন ঘাপটি মেরে - দ্যাখাই যাউক শিশিরবিন্দুকে কতখানি বড় মনে হয় সূর্যের চেয়ে। সমস্ত বিষাদ কচুকাটা করে দেশে ফিরে গেলেন লর্ড ক্লাইভ- তোরা বিষাদঘোটক আর তোরা সিন্ধুঘোটক।  বেহালাটা মাটিতে নামিয়ে নিজের শার্ট রিফু করতে করতে উকিল মুন্সি একদিন বললেন, তুমি এইখানে এসে বসো, জলে হিজিবিজি দেখ, অনেক উত্তর আছে, মজা ব্রহ্মপুত্রে তখনও কয়েকটি এলোমেলো নৌকা।  তাকালে ঝিম ধরে আসে। নৌকা প্রশ্ন করতে লাগল। বেহালাও বেজে ঊঠল অনেক প্রশ্ন নিয়ে। সূঁচ-সুতা সবাই চিৎকার করতে লাগল খালাসিটোলায়, নিউদিল্লী স্টেশনের শব্দ, আনাতোলিয়ার আদালতে- উঠোন জুড়ে কেটে ফেলা চুল,  চুম্বন স্মৃতির ঘরে উড়ো চিঠি, রেল লাইন বরাবর চায়ের ভাঁড় সবাই প্রশ্ন করতে লাগল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।