Monday, May 02, 2011

শিল্প আমাদের ভিত্তি, কৃষি আমাদের ভবিষ্যত

আমরা নেশায় বাঁচি। এটাকে অবশ্য বাঁচার নেশাও বলা যেতে পারে। হাতের কাছে অনেক সহজ নেশা আছে যেমন ইলেক্টিকের কারেন্ট খাওয়া, এটা অবশ্য মাঝে মাঝে খেয়ে থাকি। বেশ ঝিমঝিম ভাব লাগে, কখনও হাত পা ছিটকে ফেলে, কখনও টান দিয়ে ধরে রাখে অদৃশ্য বাঁধনে। ফলে ভ্যারিয়েশন আছে। এটা আপনর কোনদিনই সাপের ছোবল খাওয়ার মত একঘেয়ে লাগবে না। রাহুলদের শ্যাম্পেনে কোকেন মিলিয়ে খাওয়ার আইডিয়াটাও গুচ্ছ। মাঝে সাঝে চলতে পারে,রোজ নয়। কিন্তু নেশা তো রোজ চাই, বেঁচে থাকতে যখন হচ্ছেই। আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সেটা হাইটেক হতে হবে। টেক তো টেক না টেক তো না টেক, একবার তো সি। দেখাই যাক না, টেকনো নেশা না হলে কেন বেঁচে থাকা? সুতরাং আখ্যান আরম্ভ।

কেরালার একটা ছোট্ট দ্বীপে কৃষ্ণান ও তার পরিবার বাস করত। সেই দ্বীপে যেমন বিদ্যুৎ ছিল না তেমন ছিল না পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা। চারপাশে কাছে দূরে অন্য যে সব দ্বীপগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাদের দশা যে ঢের ভাল কিছু ছিল এরকম নয়। এই সকল দ্বীপবাসীরা পুরুষানু&#৩৪৭;²মে অনুকূল মৌসুমে চাষ আবাদ করত অন্য সময় ঘরে বসে থাকত। কৃষ্ণান ও ছিল তাদের মত একফ্সলা চাষি। যখন চাষ আবাদ থাকত না তখন কৃষ্ণানের পরিবার সহ অধিকাংশ মানুষই নিরন্ন থাকত। সেটা দিনের পরে দিন, মাসের পরে মাস। স্ত্রী-পুত্রের নিরন্ন থাকাটা কৃষ্ণান ঘরে বসে দেখতে বাধ্য হতেন কিন্তু কিছু করার নেই। কিছুই কি করার নেই? ক্ষিদের তাড়নায় একদিন কৃষ্ণান একদিন অন্যের বাগান থেকে একছড়া নারকোল চুরি করতে গেলেন। কৃষ্ণান চুরিতে অনভ্যস্ত, তাই ধরা পড়ে যেতে দেরী হল না। দ্বীপের চারপাশ দিয়ে জল অনেক গড়াল। প্রচুর ঘটনার ঘনঘটা। শেষকালে মোড়ল, পঞ্চায়েত মহকুমা জেলা ঘুরিয়ে কৃষ্ণানের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। যদিও প্রথ অহিসেবে মৃত্যুদন্ডটা খুব স্বাভাবিক ছিল না আর ঐ দ্বীপে শেষ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল বেশ অনেক বছর আগে। এদিকে সেই দ্বীপটির অন্তর্বর্তী নির্বাচনের দিন ছিল সামনে তাই রাজনীতিকরা কৃষ্ণানের ঘটনাকে ইস্যু করতে দ্বিধা করল না। একপক্ষ মৃত্যুদন্ডের পক্ষে তো অন্যপক্ষ বিপক্ষে। ফলে কৃষ্ণানের স্ত্রীও এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জুড়ে গেলেন এবং নিয়মিত সভা সমিতিতে হাজির হতে লাগলেন।

সেই সময়টা ছিল এক বিশেষ সময়। দেশ থেকে সবে দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড রদ করে দেওয়া হয়েছে । নিতান্তই নিরুপায় হয়ে উপযুক্ত ফাঁসুড়ের অভাবে নতুন টেকনোলজিতে তৈরী হয়েছে মৃত্যুদন্ডের উপায় " Throne of Death ' নামক এক মৃত্যুদন্ডের চেয়ার। চেয়ারটি দেশ তৈরী করেছে বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় ও অ¡মেরিকার প্রযুক্তি অনুসারে। এখন কৃষ্ণানদের দ্বীপের জনগন কেন্দ্রের কাছে আব্দার করে বসল, প্রথম " Throne of Death 'এর মৃত্যুদন্ডটি কৃষ্ণানকে দিতে হবে। আব্দার ক্রমে ক্রমে অন্দোলনের চেহারা নিল রাজনৈতিক দলেরা এসে ভিড়ল। অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পরে সেই রাজকীয় চেয়ারে বসে প্রথম মৃত্যুর সন্মানটি পেলেন কৃষ্ণান। তার স্মৃতিতে ঐ দ্বীপে তার একটি আবক্ষ মুর্তি উৎকীর্ণ হল। দলমত নির্বিশেষে সকলেই খুশি, এমনকি কৃষ্ণানের পরিবারও। কেন না এখন আর তাদের নিরন্ন থাকতে হয় না। বৈদ্যুতিন চেয়ারে চাপিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার জন্য ঐ দ্বীপে বিদ্যুৎ আনতে হয়েছিল; ফলে অন্ধকার দূর হল , শ্যালো ভটভট করতে লাগল, এক ফসলা জমি দু-ফসলা, তিন ফসলা, চার ফসলা হল। সাথে সাথে গ্রামের অন্যান্য উন্নতিও হতে লাগল। মূল দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধের জন্য একটা সেতুও তৈরী করে দিল সরকার।

এতক্ষণ পর্যন্ত পড়ে যারা এটাকে নেশাড়ুর কল্পনা ভাবছেন বা মনে করছেন অমি আবার একটা ঢপের গপ্পো ফাঁদতে বসেছি তারা ভুল করছেন। না এটা কোন গল্পকথা নয়। এটা একটা জলজ্যান্ত সিনেমা। মালয়ালম ভাষায় তৈরী "মরানা সিংহাসনম' (Throne of Death / 1999 / 35mm / colour / 61 mins ) । বানিয়েছেন তরুণ পরিচালক মুরলী নায়ার(murali@globalnet.co.uk) । আমাদের বন্ধু মুরলী যদিও এখন কেরালায় থাকেন না তবু কেরালা ও তার মানুষজনদের নিয়ে "অন্ধ মশকরা' করে মজা পান। আমরা পাই না। অন্তত আমরা যারা ঐসব দেশে বাস করছি, এসব দেখি আর সিঁটিয়ে যাই। "ঠাকুর ঠাকুর' করতে করতে দিন কাটাই অথবা নেশায় নেশায় সব ভুলে বেঁচে থাকার পথ খুঁজি।

আমাদের বর্তমান "উন্নততর' মুখ্যমন্ত্রী শিল্পোন্নোয়নে ভীষণ আগ্রহী কিংবা বলা যায় ওটাই তাঁর নেশা। ঘনঘন শিল্পপতিদের সঙ্গে মিটিং করছেন, বিদেশ থেকে লম্বা চওড়া টিম আসছে, জমি দেখা হচ্ছে, মানুষ আজ স্বপ্ন দেখার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। এরপরেই আসে জমি অধিগ্রহণের গল্প, শিল্প টিল্প পরের কথা। সরকার বাহাদুর চেয়েছেন অতএব জমি বাড়ি খলি করে দাও। খাতিয়ে দেখলে না কি সকলেই দেশত্যাগী, তাই এ আর নতুন কথা কি। আবার নতুন জায়গায় গিয়ে বাসা বানাও। অনুর্বর জমিকে উর্বর, চাষযোগ্য জমিকে বাস্তুজমি বানাও। যাদের বাঁচার নেশাটা ভীষণ, তারা অন্তত তাই করে। এরা কখনওই উপযুক্ত জমি, টাকা কিছুই পায় না কেবল প্রতিশ্রুতি পায়। বজবজ, বক্রেশ্বরে জমি অধিগ্রহণের সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, পরিবারপিছু একজনের চাকরী হবে নির্মীয়মান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। চাকরী হয়নি, কিন্তু তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে। বাঁকুড়ার মেজেয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরীর প্রাক্কালে জমি অধিগ্রহণের সময় প্রতিশ্রুতি ছিল আরও বেশি। এখন সরকার কাটোয়াতে আরও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইছেন, জমি চিহ্নিত হয়েছে, ভোটের আগে যথেষ্ট ঢক্কা-নিনাদ সহকারের ভিত্তি-প্রস্তর এবং পরবর্তী কার্যসমূহও শুরু হয়ে গেছে।

এসব যখন হয়, প্রতিবারই কিছু আন্দোলন সংগঠিত হয়,পরে সবাই সব কিছু ভুলে যান। কাটোয়াতেও তাই চলছে। কৃষিজমি ও ক্ষেত মজুর বাঁচাও কমিটি তৈরী হয়েছে, তাতে বিভিন্ন দলের লোক থাকলেও ইস্যুটির পক্ষে ও বিপক্ষে আছে দুই প্রধান রাজনৈতীক দল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনে কাটোয়া বিধান সভা কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছে শিল্পোন্নয়নে উন্মুখ সি পি আই এম। তবে ফলাফলে কিছু যায় আসে না,উপযুক্ত পরিমানে বিদ্যুতের যোগান না থাকলে শিল্পের চাকা স্তব্ধ হয়ে যাবে,একথা সকলেই স্বীকার করবেন। শিল্পোন্নোয়ন ভীষন দরকার, লোকের চাকরী দরকার, প্রগতি দরকার। কাটোয় স্বাধীনতার আগে যে জমি ছিল একফসলা তা এখন তিন/চার ফসলা হয়েছে বিদ্যুত ও অন্যান্য শিল্পের জন্যেই, একথাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আসলে ভয়টা এখানেই, উন্নতির নেশা যখন আমাদের একঘেয়ে লাগবে তখন আমরা কী করব অথবা যখন দেশে অধিগ্রহণের জন্য কৃষিজমি খুঁজে পাবো না তখন আমরা কী করব? খাদ্যাভ্যাস মানুষ বদলাতে পারে কিন্তু নেশা নয়; সেটা পাল্টে গেলে বুঝতে হবে ওটা আদৌ নেশা ছিল না, ছিল অন্য কিছুর ভনিতা। 



প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচন্ডা৯'র বুলবুল ভাজায়।
দেখুন এইখানে