Monday, May 02, 2011

ধান কাটা হল সারা

শ্রীচরণেষু মা,

এ বছরও পৌষ সংক্রান্তিতে বাড়ি যেতে পারলাম না। ভেবেছিলাম পুরুলিয়া যাব, দুয়ার্সিনির বাংলোয় সকাল থেকে দলে দলে মেয়েরা আসবে গান শোনাতে তারপর চলে যাব কাঁসাই নদীর ধারে, এলোমেলো পাহাড় চুঁইয়ে আসা আলোয় ঝলমলে ঘোড়ানাচ , একে একে রঙিনে রঙটানা টুসু বুড়বুড়ি কাটতে কাটতে ডুবে যাবে জলের তলায়, কন্যার বিদায় কখনই সহ্য করা যায় না। চোখ ফেটে জল আসে, আত্মীয় স্বজনদের বিয়েতেও তুমি লক্ষ্য করেছ আমি সেই সময়টা এড়িয়ে যাই। মেঘে ঢাকা তারার গানটা এত টুসুর ভেতরেও ভেসে আসে, কিন্তু বিজয়ার দিন তো কই আমার কান্না পায় না! মা গো, এত রহস্যের কিছু নেই, প্রতিবার বাড়ি থেকে আসার সময় আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা তা কেন আমিও জানি তুমিও জান।ধুস দেখ কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি, আসলে এই বছরও আমি যেতে পারব না, জানি বাড়িতে তুমি আর বাবা একা অপেক্ষা করে থাকবে, বাবা নারকোল ঝেড়ে পরপর সাজিয়ে রেখেছে, দোকানে আগে থাকতে বলে আনিয়ে রেখেছে অল্প অল্প দানা ওয়ালা ঝোলা নলেন গুড়, তুমি চল্লিশ বার বকুনি দেওয়াতে আতপ চাল ভাঙিয়ে এনেছে আর নিয়ে এসেছে ক্ষোয়া ক্ষীর। প্লিজ তোমরা পিঠে-পুলি সব করে খেও, দ্যাখো আমি ঠিক কবে যেতে পারবো এখনি বলতে পারছি না। পুরুলিয়া না গেলেও বাড়ি যাবো না। আসলে এবার পুরুলিয়া যেতেই চেয়েছিলাম, অনেকদিন নতুন ধানের গন্ধ পাই না তো মা, পোড়া মবিলের গন্ধে ঘাড় নিচু করে রাখি সবসময়। এমু যেতে রাজী হল না, তাই হয়ত সকাল বেলায় কেঁদুলি চলে যাব।


মা, তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি হয়ত পালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কেন তুমি সেটা প্লিজ একটু বুঝ। আসলে আমি এইদিনে তোমাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। যখন ছোট ছিলাম তখন এতটা মনে হত না, বাবার লেপের ভেতর কোলের ওম নিয়ে নবান্নের গল্প শুনতাম। সে ওম আর রইলনা, গল্পেরা হারিয়ে যেতে লাগল। আমার বড় হওয়ার সাথে সাথে নবান্নের গল্প এক ঘেয়ে হয়ে পড়ে, যেমন বাবারাও বড় হওয়ার সাথে সাথে গৃহহীণ হয়ে পড়ে এবং নবান্নহীণ। আমার ছোটবেলা জুড়ে নতুন চালের গন্ধ ছিল না,গ্রামে থাকতে পছন্দ করতাম না, সোনার সীতারে হরেছে রাবণ পল্লীর পথ পরে'র চাইতে বেশী পল্লীকবিকে চিনতাম না। এদেশে আমাদের জমি নেই, তাই নবান্ন নেই, সংক্রান্তিতে কেবল পিঠে পার্বন। আমি জানি তোমাদের এখনও এটা মেনে নেতে ভীষণ কষ্ট হয়, আমারও তখন তোমাদের মুখের দিকে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হয়, আমি এড়িয়ে যাই, পালিয়ে যাই। তোমারা অন্য কষ্টের ভেতর বাংলাদেশকে লুকিয়ে রাখো।

আসলে মা, আমি না মিছিমিছি কষ্টপাই। এই দ্যাখো সিঙ্গুরে কতলোকের জমি একসাথে চলে গেল। সেখানে ফ্যাক্টরী হবে। এরকম এর আগেও গুচ্ছ হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। অনেকেই চড়া দামে জমি বেচেছে, টিভিতে আমি নিজে দেখেছি, তাদের হাসি মুখ, তারা বলেছে, এবার তাদের জীবন কত সুরক্ষিত, সুরক্ষিত তাদের সন্তানের ভবিষ্যত। পরপর দুদিন আসানসোল আর বর্ধমান গেলাম সিঙ্গুরের উপর দিয়ে, গিজগিজে পুলিশ ছাপিয়ে চোখে পড়ল সোনালি ধান। কাটা হয়ে গেছে, কোথাও স্তূপীকৃত কোথাও এলোমেলো। আমার তোমাদের মুখ বেশি মনে পড়ল, নিজের সন্তানকে নতুন ধানের গন্ধ না দিতে পারার কষ্ট নিয়ে সেই পিঠে- পার্বনের রাত, বাবার গল্পের মানে আমার কাছে ছিল পিঠের জন্যে অপেক্ষা, তুমি পিঠে বানিয়ে নিয়ে আসতে, আমাদের সেদিন ভাত-রুটির পাঠ থাকত না। আজ আমার সেই অপেক্ষাও নেই, কেবল পালিয়ে বেড়াই। এ বছর দ্যাখো কতগুলো বাড়িতে শেষবারের মত নবান্ন হচ্ছে। নতুন করে আর গল্প তৈরি হবে না তার সন্ততিদের জন্য। আচ্ছা মা, সন্তান কি খুব জরুরী? সে তো কেবলই তোমাদের কষ্ট দেয়, তাই না?



প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচন্ডা৯'র বুলবুল ভাজায়।
দেখুন এইখানে