Monday, May 02, 2011

আত্মহত্যার অধিকার

আঁধার সম্যক কৃষ্ণবর্ণে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে রঙ্গীন সূচিশিল্প, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। এই ভাবে নিজেকে নিজে আস্বস্ত করি, এমনটাও কানে আসে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। মুস্কিলটা হচ্ছে এই পাপ-ফাপ যেমন বুঝি না তেমন এটাও বুঝতে পারি ক্রমশ আত্মহত্যাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, সকলেই এগিয়ে চলেছি সেই লক্ষ্যে। সুতরাং আখ্যান আরম্ভ।


১৩ই এপ্রিল ২০০৬ আমি জানতে পারি আমার নয়জন বন্ধু আত্মহত্যা করে ফেলতে পেরেছে, এরা সকলেই পোলট্রির ব্যবসা করত। কেউ পশ্চিমবঙ্গে কেউ অন্ধ্রে,কেউ মহারাষ্ট্রে । এরা সকলেই আত্মহত্যার সুযোগ খুঁজছিল। এইচ পাইভ এন ওয়ান আভিয়ান ফ্লু নামের এক ভাইরাস আসায় এদের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি। সারা ভারতে ১২৩,০০০ পোলট্রি চাষিদের মধ্যে নাকি সত্তর শতাংশের অবস্থাই মারাত্মক। মুরগী বিক্রি যখন রাতারাতি পড়ে গেল তখন তারা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে চেষ্টা করে ছিলেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার।



ভেঙ্কান্না রামান্না রাই, একদা গুন্টুর বাসি একুশ বছরের উজ্জ্বল তরুন, এসেছিলেন বিদর্ভে। ২০০৬ এর ২রা ফেব্রুয়ারী কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ভুমিহারা এই চাষি চাষ করতেন অন্যের জমিতে। উন্নত ফলনশীল বীজ ও কীটনাশকের প্রভাবে এই বছর লঙ্কার উৎপাদন হয়েছে প্রচুর। ২০০২-২০০৩ সালের থেকে দাম দাঁড়িয়েছে ঠিক অর্ধেক। নাগপুরের ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে তা ঠিক করেছেন। ভেংকান্না লিজে ৪৫০০ টাকা প্রতি একর হারে জমি নিয়ে ছিলেন নয় একর, এছাড়া বীজ। কীটনাশক, বিদ্যুত, যানবাহনে খরচা হয়ে ভেঙ্কান্নার ঋণের পরিমান দাঁড়ায় ৬০,০০০ টাকা। ফসল উৎপন্ন হওয়ার পর দেখা গেল তার দরকার ২০ কুইন্টাল শষ্য। অর্থাৎ তিনবছর। এর থেকে আত্মহত্যা নিশচিত সহজতর। বিদর্ভে এই চাষ- মরশুমে যে ৩৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন তার তালিকায় ভেঙ্কান্নার নাম নেই কেননা তিনি তো তেলেগু চাষি। পান্ধরকাওড়া সাব ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালের লগবুকে ভেঙ্কান্নার নাম নেই, অথচ তার পোষ্টমর্টেম সেখানেই করা হয়েছে।

কয়েক মাস যাবত মিডিয়া অন্ধ্র ও মাহারাষ্ট্রের গুচ্ছ গুচ্ছ আত্মহত্যার ঘটনা ছেপে চলেছে। এর কারণ না কি অর্থের স্বল্পতা। এটা হয়ত বা ঠিক , কিন্তু পুরোটা নয়। আত্মহত্যা খুব সহজাত ঘটনা, আকছারই হয়ে থাকে, নানাবিধ কারণেই। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কারণেও হয়ে থাকে সে সব আমরা সকলেই জানি। হুএর কথামত আত্মহত্যার বিশ্বব্যাপী হার ১৪.৫ প্রতি লাখে। সেখানে ভারতে জনসংখ্যার হিসেবে দাঁড়ায় ১৪৫০০ জন প্রতি বছরে। গল্পটা সেখানে নয়,ভারতে ঠিক যতগুলো আত্মহত্যা ঘটে তার অধিকাংশেরই হদিস থাকে না, বস্তুত এটা একটা অপরাধ। ২০০০ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো নথিবদ্ধ করেছে ১০৮,৫৯৭ টি আত্মহত্যার ঘটনার। অর্থাৎ ভারতে আত্ম্যহত্যার সংখ্যা প্রতিদিন তিনশটি বা প্রতি পাঁচমিনিটে একটি।

মজার কথা হচ্ছে রেকর্ড ঘাঁটলে পাওয়া যাচ্ছে ভারতে আত্মহত্যার মূল কারণ দারিদ্র নয়, বেশীর ভাগ কারণ অসুস্থতা,বার্ধক্য, একাকীত্ব, সাংসারিক ঝামেলা এবং বিবিধ ক্ষুদ্রাতীত ঘটনাবলী। দারিদ্র এই তালিকার শেষ দিকে আছে। কেননা রেকর্ডে আছে সারা বিশ্বে ষাটোর্ধ মানুষ ও ১৫- ২০ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার মোট হারের ঠিক তিনগুণ। যারা বস্তুত আয়ের হিসেবে নেই। ফলে খুব কম আত্মহত্যাই দারিদ্রের কারণে ঘটছে, এটা বলা হচ্ছে। ভারতে যে পন্ডিচেরীতে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী, ৫০.৮৫ প্রতি লাখে,সে দারিদ্র সীমার ধারে কাছে নেই।

এউ এস এ আত্মহত্যার হার ১৩.৯ প্রতি লাখে। রেকর্ড বলছে সেখানে সাদা দের আত্মহত্যার হার কালো দের থেকে বেশী। টিনএজদের আত্মহত্যার হারও প্রচন্ড বেশী । উন্নত দেশগুলোর চাইতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের আত্মহত্যার হার কম। এর প্রধান কারন হয়ত জনসংখ্যায় মুসলিমদের প্রাধান্য,ইসলামে ঐ পাপের ফান্ডাটা বেশ জোরদার এবং তারা সেটা বিশ্বাসও করে। সারা পৃথিবীতে মহিলাদের থেকে পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশী প্রায় তিনগুণ যদিও দারিদ্রের হার ও নির্যাতীতের হারে মহিলারা অনেক এগিয়ে পুরুষদের থেকে। সুতরাং এগুলো বারে বারে প্রমাণ করছে আত্মহত্যার সাথে গরীবদের ও নির্যাতীতদের যোগ কম।



সম্প্রতি অনুরাধা বোসের একটি লেখা থেকে জানা যাচ্ছে ভারতে সর্বাধিক আত্মহত্যার হার ১৫-১৯ বছর বয়সী তামিল মেয়েদের মধ্যে ১৪৩ প্রতি লাখে যা প্রায় বিশ্বের আত্মহত্যার হারের দশগুণ। অনেক সময় মিডিয়ার লেখালিখিও আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়,অধ্যাপক দিনেশ মোহনের এই ব্যাপারে একটি সুবিস্তৃত লেখা আছে, ১৯৯০ সালে ম¾ডল কমিশনের বিরুদ্ধ প্রতিবাদে কি ভাবে আত্মহত্যা সংক্রমণের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সংবাদে প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে। এদের সকলের বয়স ১৫- ২৯ এর মধ্যে, যারা চটজলদি আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এত্ত সব হিসেব নিকেশ করে বলা হয়ে থাকে ভারতে দারিদ্রের কারণে আত্মহত্যা মোট আত্মহত্যার কেবল ৫ শতাংশ। ফলে যারা দরিদ্র তাদের আত্মহত্যার অধিকারও অনেক কম। নতুবা তারা সত্যিই আত্মহত্যা করেন না। কাজেই ভেঙ্কান্নার মত দু-চার জন ছুটকো-ছাটকাদের তালিকা থেকে বাদ দিলেও হিসেবে গরমিল হওয়ার কথা নয়।



প্রকাশিত হয়েছিল- গুরুচন্ডা৯'র বুলবুলভাজায়।
দেখুন এইখানে