১
আমার কাছে কেউ কেউ জানতে চায় পৃথিবীর কোন নারীকে
আমি প্রথম ভালোবাসি
কেউ কেউ জানতে চায় কাকে আমি প্রথম চিঠি লিখি,
কেউ বলে, প্রথম গোপনে কোন নামটি আমি লিখে রেখেছিলাম;
প্রথম আমি কী দেখে মুগ্ধ হই, প্রথম কার হাত ধরি
আমার প্রথম স্মৃতির এই সব প্রশ্নে আমি ঠিক কিছুই
বলতে পারি না, বোকার মতো চেয়ে থাকি।
প্রথম অশ্রুবিন্দুর কথা কার মনে থাকে, তারপর এতো বৃষ্টি এতো বর্ষা
মাটির শ্লেটে প্রথম যে অক্ষর লিখেছিলাম আমি
তা আর কিছুতেই কারো কাছে বলা যাবে না,
প্রথম কবে সেই রাজহাঁসটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলাম
সেই শিহরণ কবে বাতাসে মিশে গেছে,
পুকুরপাড়ের ঘাটলার সিঁড়িতে যে নাম প্রথম খোদাই
করেছিলাম আমি
এতোদিনে চোখের জলে তার কোনো চিহ্নই আর নেই
আমি সেই আদ্যক্ষর কী করে দেখাব?
আমি কী করে দেখাব প্রথম স্বপ্ন দেখে আমি
কীভাবে সারারাত কেঁদেছিলাম,
ভালোবাসা কথাটা প্রথম বলতে গিয়ে কত লক্ষবার
মুখ ঢেকেছি আমি,
প্রথম কবে আমি বর্ষণ দেখলাম পৃথিবীতে
কবে প্রথম পাখির ডাক শুনলাম, সন্ধ্যাতারা
দেখলাম
না, না, সেসব কিছুই আর আমার মনে নেই
কারোরই মনে থাকে না।
কবে কে আমার হাতে লুকিয়ে একটি গোলাপ ফুল
দিয়েছিল
বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়েছিল একখানা লাজুক চিঠি
কে বলেছিল কানের কাছে কোকিলের মতো মাতাল করা
একটি শব্দ
সেসব কিছুই আর আমার মনে নেই, মনে নেই।
সে যেন কোন ছেলেবেলার হারানো গুহায় মাঝে মাঝে দেখা পাই একটি শরীরে ফুটে আছে কয়েক স্তবক পলাশ, সে শরীর দম দিলে নড়ে চড়ে কথা বলে, জোৎস্না হয়ে ফুটে থাকে কোন পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা রাত্রে, আমরা অনেক অনেক মাতাল হলে কুয়াশার ভেতর তাকে দেখি। আমার ছেলেবেলা জুড়ে খাঁজ কাটা রেলিং এ মোড়া যে ডাকটিকিটের সাইজের একরত্তি মফস্বল সে কেবল নাগাল পায় না ক্রমশ আবছা হয়ে আসা সিমি গাড়োয়াল গাড়োয়াল শরীরের, কোনে কোনে ঝুমকো ঝুলে থাকা গোছা গোছা ফুল, আবছা গড়নে মুড়ে রাখা সেলোফেন পেপার, হাওয়া দিলে খালি কলসের প্রবাদে মসমস করে ওঠে, কানে বাজে স্কুল ঘরে দেখা এক সিনেমার রেলের বাঁশি, চল পালাই পালাই, সান্ধ্যবাসরে গুরুসদয় দত্ত। ট্রেন ঠিক গতি কমিয়ে নিলে, মানকুন্ডু আর ভদ্রেশ্বরের মাঝামাঝি আমি এক ল্যাম্পপোস্ট গাছ দেখি। লাল লাল ফুল থোকা থোকা। একে একে আরো মানুষ মানুষ গাছ। ঠিক যেন অরুণ চক্কোত্তি ঝোলা থেকে লজেন্স বের করে আমাদের দিচ্ছেন সারা কামরায়। আমাদের মফস্বল বড় হচ্ছে সাইকেলের লাইসেন্সে। ওপাশে কেমন জানি রেল লাইনের গরম হওয়া পাথরে দেখতে পাই নানান রঙ আর ঐ অর্ণপূর্ণা ব্রীজের নিচে, ওই দ্যাখো ঐ পারে লা স্ত্রাদার আসর বসেছে বালিতে, ইকড়ি মিকড়ি ভালবাসার অস্ফুট আঙ্গুল। এমন বাসন্তীরাতে সারা রাত পটা বাঁশি বাজায়, আমি ঘুমের ভানে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়ে মুছে দিতে থাকি চোখ পিটপিটের বেলো টানা। কাল দোল, এমন তো কত দোলই থাকে জীবন জুড়ে, ছেলেবেলার কাঁদিতে সাজানো থরে থরে। এখন সে কোকিলের বাঁশিতে বাজে না বাহার বা জয়ন্তী আরো ভারী হয়ে আসা দুই চোখের পাতার ওঠানামা সঙ্গে নিয়ে। প্রেম ফেলে রেখে চলে আসি এমন কোন আবীর মাখা গালে, অজন্তা পাহাড়ের গায়ের কোন গুহায়, সব দর্শনার্থী ফিরে গেলে নিভিয়ে দেওয়া হবে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প বা কোন রোদ না আসা বারান্দায়, ন্যাড়া এল শেপের গাছহীন টব বসানো ছাদে, ড্যাম্পে ভেজা সবুজ কলতলায়, ঘুন ধরা চিলেকোঠায়, এক মাথা মফস্বল কিছুতেই ইরেজ হচ্ছে না আমার, নাম-ধাম- জানালার রেলিং ও পাপবোধগুলি।
এমন নাগালটা ত পাইনি সেইদিন, মাঠ ঘাট হেঁটে যাওয়া। পুজো ও সাজগোজে পাশাপাশি, আসলে কথারা তখন ছুটে ছুটে বেড়ায় এই খই তো এই পক্ষীরাজ। কখনও বা চুল এসে পড়ে আর তারপর সেই অদম্য লড়াই চোখ পিটপিটের সঙ্গে সারাটা রাত জুড়ে, জুড়ে জুড়ে আরও অনেক বড় রাত হয়ে ওঠে সে রাতখানা। রাত যত বাড়তে থাকে বাঁশী তত তীব্র, শেষ রাতের ঠান্ডায় চাদর টেনে নিতে ভুল হয় না একদম, কত সহজে লুকিয়ে ফেলা এত অস্বস্তির চোখ পিটপিটানি। এই ভাবে কত দূর যাওয়া যাবে বল? আমার কোন দেশ নাই, ভাই নাই বোন নাই, আছিলারা শেষ হয়ে ধরা দেয় একদিন দোলে, সেই যে আমাদের ছেলেবেলা ফেলে দেওয়া বিড়ি খাবার চিলেকোঠায়। রঙের শরীরে রঙ গিরগিটির মতন সহজে মিশে যেতেই আবিষ্কার করি ফুটে ওঠা কতদিনের পুরানো এক নদী, আমাদের কুষ্ঠিয়ার বাড়ি ঘেঁসে চলে যাওয়া বজরা নৌকা আর ডুবে থাকা পানকৌড়ির নবগঙ্গা, ওষ্ঠের ভিতরে রঙের স্বাদ ফুটে উঠতে উঠতে আমি দেখতে পাই থোকা থোকা লাল মাদার ফুলের এক শরীর। বিকেলে গানের আসরে, হ্যাঁ হ্যাঁ এই সব মফস্বলি ভ্যানতারায় আমি লটকে আছি সারাটা জীবন, আমি তাই নেহাত পাশে বসার আছিলায় আবেগের ঘুড়ি টানটান করে লাটাই ছুঁইয়ে বসে থাকি, রাগ ও রাগিনী এঁকে বেঁকে হয়ে যায় ধ্রুব মিস্তিরির কোন ফাউন্টেনের উরু ও নিতম্বদেশ। তাতুদিরা মেলা গান গায়, আমি চাই, চাই আজ আরও, আরও গান হোক রাত ভোর, রঞ্জনদা সারোদ বাজায়, আরো কত কী ঘটে আলি আকবর থেকে পিকাসো, সব ভুলে যাই আমি অকৃতজ্ঞ ও অকর্মণ্য, যেন কোন গাছের কোটরে ফেলে এসেছি প্রথম চুম্বনের স্বাদ। ধোঁয়া হতে হতে ঠোঁটখানা একদিন তুলসিপাতা হয়ে গেলে, মনেও পড়ে না কত গাছ আর বসন্ত পার হতে হতে ছুটে গিয়েছি গাড়োয়াল থেকে দুমকা পাহাড় আর কেন্দুপাতার ছিপি খুলে নিজে হাতে মুছে দিতে থাকি চলন-ঘুর্ণণ-প্রতিফলনের স্লেট আর দীর্ঘশ্বাসের বালিয়াড়ি।
আরো কিছু প্রেম ছিল বলে আমার অনুমান, ঠিক ঠিক মনে পড়ে না সব। ক্রমান্বয়ে ছোট শহর ঢুকে পড়ে অন্য বড় কোন শহরের বুকে আর আমার মফস্বলী বৃতান্ত এক শান্তিনিকেতনী টোপলা আশা ভরসা দম বন্ধ করে রাখে আরও কোন দোলের জন্য, সে এক অনতিক্রম্য রাজাকাটারার কাদা ছোড়াছুড়ির জ্যাম, জানালা অন্ধকার বাসে কত পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর বাগবাজার ঘাট। বোধরোহিত অনুপানে অস্থির সিঁড়ি সকল উরে উড়ে চলে যায় বিবিধ প্রেমের চক্রান্তে। পুটুর কথা মনে পড়ে, সবুজ রঙের ডালপালা সমেত পুটু, ঐন্দ্রিলার মামাতো বোন, মন্থরার মত আমার হাতে ঢেলে দিতে থাকে রঙ, যেন সে রোজই এমনটা করে থাকে, ঢালে জল, একসময় বোধকরি হাতে তুলে দেয় গোটা নদীটাই। দেশ আর আমার কোথায় বল তবু এক চিলতে সান্ত্বনার মত যে নদী জুটেছে তাতেই ভাসিয়ে দি রু’কে। বজরায় চলেছে সময়, চারপাশে লাফিয়ে উঠছে মাছ। ব্যাঙ্ককের রাতে মাছেদের এমন খাবার ছুঁড়ে দিতে দিতে চারপাশে কখনও বা ভরে যায় গাঢ় সবুজ রঙ। তারপর সিদ্ধিতে বুঁদ হয়ে সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি খুঁজে বার করব রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে, হায় তখন বিক্রিম সিং-এর নেশা টের পাইনি তবু নেশার রুমাল তাই পাকিয়ে টাকিয়ে বাঁধি চোখে। পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি। লেবেল ক্রসিং ও শরীর, সেই ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল হয়ে যাওয়া গাছ। সুতো ছিঁড়ে উড়ে যেতে বেলুন, আর এতদিনকার দমবন্ধ করে অপেক্ষা করা সিনেমার চোরাবালি- ঋত্বিক, মিজোগুচি, সাকুরভ, পারাদ্যাঝনভ, মানেকা ভিত্তি, ব্যালাড অফ নারিয়ামা, মণি কাউল, সিদ্ধেশ্বরী আমাকে ডুবিয়ে নিতে থাকে রঙের সমুদ্রে। হায় আমার পাশবালিশের মত জাপটে থাকা নদী আর আমার থাকে না, আমি অন্য নারীতে যাই অন্য মহাকাশে, মফস্বলী সিদ্ধান্ত ভেঙেচুরে তচনচ। দোলের নামতা মিশে যায় শিশিরে। হেঁটে যাওয়া পথ ধরে সবুজ এখন কেবল চটকানো ঘাস, কান্দিনেস্কি ফিরে এসে আরেকটু রঙ চাপাবেন।
২
আমরা ছিলাম গোপাল উড়ে। আমরা ছিলাম জেলে পাড়ার সঙ।
কবিগানের চাপান উতোর। দল বেঁধে সেই নগরে কীর্তন।
রাত্রি জেগে যাত্রাপালা। হাফ আখড়াই। আজান। আগমনী।
নিধুবাবুর টপ্পা শুনে আমরা ছিলাম ‘আর একটা হোক, আরও-’
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’। অর্কেস্ট্রায় সুরের নোটেশন।
লোকাল ট্রেনে অন্ধ দুজন। হারমোনিয়াম। বীণার পাশে বেণু।
আমরা ছিলাম বসন্ত আর বর্ষাবরণ। ছাত পেটানোর সুর।
ইটখোলা, মিল, রেল ওয়াগন- ‘হেঁইয়ো জোয়ান’ আমরা সবাই ছিলাম।
বাসন্তীদি রেওয়াজ করত, চারটে ছেলে জানালা দিয়ে উঁকি।
ডোভার লেনের টিকিটকাটা আমরা ছিলাম মাটির ভাঁড়ের চা-এ।
রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি এবং রেডিও থেকে টিভি, কলের গান
আমরা যত ভোর হয়েছি বিসমিল্লার সানাই উপচে প’ড়ে
সেই সুরে আজ কোকিল ডাকছে ‘আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ’-
আমরা শুধু বাংলাভাষায় গদ্য হয়ে ঝরি!
( ডোভার লেন মিউজিক সন্মেলন- পিনাকী ঠাকুর)
ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছি আমি লিখে চলেছি ক্রমাগত। বিভিন্ন রঙের পেন ফেলে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কালো কালির দামী কলমে। অহরহ দোলের কলম তখন পিচকারী। শুকনো ঘাসের শহরে বেদনার সার সার বোতলগুলিতে জমা রেখেছি ছোট খাট হাফ ও কোয়ার্টার প্রেম। গানশোনা শেষে ক্লাস ঘরে ঢুকে বুঝবার চেস্টা করেছি সাদা দেওয়ালেতে লেখা বৈষ্ণব পদাবলী। কোনদিন যদিও বা বৃষ্টি নামে এই নয়ডা শহরে, তুঘলকী কায়দায় ঘুরে বেড়াই শূন্যমাঠে, ললিতকলা আকাডেমির করিডোরে। এক গভীর চোখের মালায়ালী একদিন তুমুল ঝড় বাগিয়ে বল্লো, এই কাঁচ আর পাথর সব ভেঙ্গেচুরে দাও। যমুনা নদীতে অথচ তখন শুধুই সাবানের ফেনা। এরপর একদিন কাঁচ পাথর ও ভ্রম ভেঙ্গে গেলে কোন এক পূর্ণিমার অস্থির রাতে চলে যাই জয়পুরে। ময়ুরেরা লাফিয়ে পার হয় রাস্তা আর আমি যাই উড়ে উড়ে। ঝকঝকে রাস্তার পাশে ঠান্ডা বিয়ারের আয়োজন ও মেলা প্রলোভন। কাঁদতে গেলে এমনই শুনশান রাত লাগে, এমন শুকনো চারিপাশ আর ওই দরজা ঢাকা চাঁদ। সকাল হতে না হতে সব রঙে ভরে যায়, রাস্তা ঘাট ও ঘর। কানে সর্বদা বাজে তামাটে সারিন্দার সুর, চারপাশে রামধনু দেখি আর বুঝতে পারি অনর্গল যা এতদিন লিখে চলেছি আমি তা আসলেই আমার মফস্বলী বর্মে ফিরে আসার উপাখ্যান, লালজুতো পরা খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের সাদামাটা একঘেয়ে কাহিনী। এমনটাই লেখা হবে জানি শুকনো কাঁটায় ঘেরা ঊষর দিন, একা সপ্তহান্তে পাহাড়ে যাই, একা ঘরে কাঁদতে কাঁদতে কলম বন্ধ করে হাসি। ছাত্র- ছাত্রী, টু বি স্পেসিফিক, প্রশান্ত ও পারমিতা এসে ঘরে বসে থাকে দীর্ঘায়িত অন্ধকারে। কদাচ সম্বিতে ফিরে তাদের সঙ্গে দেদার গল্প, কথা বলি, হাসি, ছবি আঁকি মিশে যাই কত গানে চন্দ্রবিন্দু, সুমন, মৌসুমিদি, নির্মলেন্দু, শিলাজিৎ, জেমস আর আমার পুষে রাখা নদীটির পাশে মাকড়সার তারজালি। আর দেড় পাতা লেখার পরের কাটাকুটির অন্ধকারে। আমি ও আমার পিচকারী লিখে চলি ক্রমাগত, ক্লিশে ছোট শহরের উপাচার। একটু চুড়ির শব্দ, দরদাম, অন্য শহর, রুলটানা মফস্বলী বৃত্তান্ত।
৩
মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে-
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে
তাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাবারের ছলে
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।
একদিন হাতের কাছে পাওয়া গেল দেশটাকে। নবগঙ্গা আর নেই। পাঁক শুকিয়ে খটখটে হতে স্যালোর পানিতে নেহাত ধানজমি। মাঝে মাঝে দু-একটা লাল মজ্জার কাঁঠালগাছ। আমার বাপ-জ্যাঠারা চড়ে-টড়ে থাকবে। বাড়ি-ফাড়ি আর নেই, আসলে একমাত্র আমরাই জমিদার যে ছিলাম না, অনুযোগ ও অনুতাপহীণ সবাই জানে। তবে বড় নগ্ন আমার এই দেশটা। শিরা-উপশিরা সব দেখা যায়। ঘোরা যায় নদীতে নদীতে। মেহেরপুরের পথের সেই পানের হাটে রসিক বাউল। আর জাফলং পাহাড়ে নৌকায় ন্যাড়া চা বাগানের ঘেরে টুকটাক কীর্তনে চন্ডিদাস আর গোবিন্দদাস আসেন। প্রেম প্রেম রোদ্দুর। আগমন প্রতীক্ষা। চন্দ্রাবলীর সঙ্গে দেখা হয় অহরহ। কনক একটা অদ্ভূত রাধারমন গাইত, বইতে পাইনি, আগে শুনিনি, শুনলেই, কণিকার পদ্মটি নাই পদ্মটি নাই মনে পড়ত। মধুকবির কোকোনদ শব্দটাও তেমনি নাছোড়বান্দা। আমার যত অবিরত ইশারা একটি একটি পাখি শিশির আর ঘাসের দঙ্গলে দুমদাম ফুটে ওঠা বেহিসেবি ফুলে আরো একটি দেশের সন্ধানে সকল অর্জনই উৎবৃত্ত মনে হয়, যেমত শ্রীকৃষ্ণ অভিসারে যেতেন অহরহ। চারুকলার চত্বর বৃন্দাবন, ঐরমটাই ধরা থাকে ফেসবুকে। বান্ধবীর সংখ্যা, দেশ, রঙ। আরে সে ফাগুণ যে এই ভাবে আসে, আমার কেবল রোমকূপ বরাবর শব্দের সজ্জা। পূর্ণিমার ঢের বেশী, আমি নেহাত গুনি না। নারায়ণগঞ্জ পেরিয়ে কতিপয় আশ্রম, সন্ধ্যার খঞ্জনি- টঞ্জনি, আমার মফস্বলী অর্জন, কোন এক বাড়তি পূর্ণিমায় এক ছিপনৌকায় আমরা সাঁতার কাটি। সঙ্গী গল্পকার কাজল সচেতন করে, এমনই মজা পুরোনো নদীর ঘাটে বসে কাঁদে চার-পাঁচশ বছরের রাধারা। মাঝিকে ধরে গল্পের শয়তানী। হাতছানি দেয়। বাঁকে বাঁকে আশ্রম, নদীর নাম কাইক্যাটি। কাইক্যা মাছের মত নদীতে তার সুচারু ঠোঁটের মত উপহাসসম নৌকাটিতে আমরা ছিলাম নারীবর্জিত, শেষ পর্যন্ত বেঁচে। আর একবার চলে কুসুম কুসুম চর ছুঁইয়ে ব্রহ্মপুত্রদিয়ে সারটা দিন। রাত্রে পৌঁছালাম চিলমারীর ঘাটে, চারশ বছরের পুরোনো জোৎস্না ভীড় করল চোখে মুখে। নীল অন্ধকারে সারসার নৌকায় এলোমেলো ট্রাঞ্জিস্টার। হ্যাঁ বিলক্ষণ ছবি বন্দোপাধ্যায়। বড় বেশি চাঁদ ওঠে আকাশ জুড়ে, ফুলটাস চাঁদ।
আমি লিখি। বরিশালের নৌকায় প্রাতঃভ্রমণে বৈঠাঘাটায়, নৌকায় নৌকায় বাজার, শাপলা, লাউশাক, পুরোনো নারকোল ভেঙ্গে মাথা তোলা চারা, লাল-লাল গুলাশ। গুইড়া বাইল্যা। পানিবিহণে ব্যথায় নীল শ্রীকৃষ্ণ ইচামাছের মত লাফান জালের ওপরে। ঢাকা শহরে, কাওরান বাজার। চন্ডিদাস মৃত্যু পরবর্তী অধ্যায়ে এখানেই ছিপ ফেলে বসে আছেন এযাবৎ কাল। ক্যালিগুলার মত পিচ্ছিল এক মাছের আড়ত, ক্রমান্বরে সবজি, শুটকির সমাহার ও মাছের বাজার, মাছ, রঙ, মাছ, ফসল, লতা, পাতা, মাছ, শাক ও সবজি। আমি দেখি হাজার হাজার নৌকা, লক্ষ লক্ষ জাল; আর একটি দেশকে, সব সাজান আছে সেই সহজিয়া বৃন্দাবনে। রাস্তা জুড়ে লাফাচ্ছে হাজার হাজার কৈ মাছ।দেদার রঙে। চার-পাঁচ লরি বাসন্তি কামরাঙা তৈরি করছে কার্সিয়াং শীতলতা। বরফে নীলে শুয়ে শুয়ে চার-পাঁচটা ২৫ / ৩০ কেজির নূরজাহানের মত আড় মাছ, আমাদের তপবন উপবন সোনালী হয়ে আছে কত-অজুত-নিযুত লক্ষ কোটি অপ্সরা উর্বশী গোলাপজামে। কোথাও পিয়ারা, কোথাও গণেশ পাইনের টেম্পারায় জামরুল, কোথাও হাজার রকমের বোড়ই। স্ন্যাপশটের মত দেশ দেখি। গল্পে, বর্ণে-গন্ধে-গন্ধে স্পর্শ করি। ভাঙচুর করি। লিখি, চ্যাট ও ফেসবুক ও ব্লগ। নারায়ণগঞ্জের ঘুম ভাঙ্গা চরের বাজারে দিশেহারা হই, সে শুধু বাঙ্গড়ি আর তরমুজের বাজার। সন্ধ্যার বুড়িগঙ্গায় হাজার হাজার নৌকায় কেবল তরমুজ, সে কেমন রঙের খেলা, আহা, সুর্যটাও সুযোগ বুঝে ঢলে পড়ে। পার্বতীপুরের হাঁসেদের হাটে আমরাও নেচেছিলাম একদিন আদিবাসী রমনীদের সঙ্গে দূরে কয়লা পোড়ার উত্তাপ-গন্ধে ফুলবাড়ি দুলে উঠেছিল সপ্তান্তের হাটে। ফিঙেদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি দেখেছি ভালুকাপাহাড়ের নীচে নিতাই নদীতে রাই কেঁদে কেঁদে ফেরে, আমার কলম শুকিয়ে আসে রৌমারিতে শ্রীরাধার আহাজারি শুনে। ঝড় জল বাণে শাসনে আরো কিছু ঘর ছাড়া হবে মানুষ। কেঁদে ফিরবে প্রেম। মুছে যাবে রাতের সব রঙ জৌলুস, অতিরিক্ত সব চাঁদ। কেউ সকালের আলোটুকু বেচে দেবে কোন হাটে। তোমরা দোলউৎসব তুলে রেখ রঙ, আবীর, পিচকারীতে, সুপ্ত যৌবনে। দেশ বলে কোন ঋণ রেখ না কোথাও।
৪
আবার ফিরে এলাম,
আর একটু খোঁজ নিয়ে এলেই ভাল হত।
বাড়ির সামনের দিকে
একটা কয়লার দোকান ছিল
কাঠ, কয়লা, কেরোসিন – খুচরো কেনা বেচা,
কেউ চিনতে পারল না
দু’জন রাস্তার লোক বলল,
‘এদিকে কোনো কয়লার দোকান নেই
গলির এপারে রাধানাথ দত্তের গ্যাসের দোকান
সেখানে খোঁজখবর নিয়ে দেখুন।
‘মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, ‘নাগরিক’।
চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট,
এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি।
কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট?
স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল,
তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে -
কোনও খোঁজখবর রাখি না,
শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি।
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।
শহর এখন পালটে গেছে শহরে, যাই ফিরি অহরহ যাতনার শহরে। এই তো জাপানে বেবাক হাওয়ায় মিশে গেল তেজস্ক্রিয়ার খেলনা-পাতি, ঝাঁঝ-রোদ্দুর-গেরস্থালি। মৃত্যু এখন সহজতর। গঙ্গার ঘোলাজলে বেবাক ছায়ায় পাটকল, চিমনিহীণ, অবরূদ্ধ যৌনতা। ওই সব সার সার আমাদের ফেলে আসা পিচকারী, আর সব রঙ মিশে এই হুটোপুটি জলে ঘোলা হল ছায়াদের দল। আমি বাজারে বাজারে ঘুরি, মুগ্ধ চোখে দেখি মৃত মাছ কেমন বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। যেদিন আমি সত্যি সত্যি চলে যাব কোন সাগরের তলদেশে, দেখব আমার প্রেমিকারা ছুটে আসছে দূর দূর থেকে, আলো কোলাহল ও ল্যাজনাড়া। কোন এক পাথরের ফাঁকে আটকে থাকা একটা ইস্কাপনের তিন ফোঁটা আমি চিনে ঊঠব তার ভাঁজ করা কোণা দেখে। পাথরে পাথর সাজিয়ে সেতুবন্ধন পালা শেষ হলে জলতলে ঘুরে বেড়াবে দুঃখহরণের গান। মৌসুমিদি তার বিরহের ঝাঁপি খুলে বসেছে এক কোণায়। আপাতত থাক, তোমার কাছে কতদিন কীর্তন শুনব বলে আবদার করিনি আমি! আর তারপর আলোড়ন, জলতল ভেসে যায় সিডিতে সিডিতে, এক জাহাজ সিডি নিয়ে টাইটানিক ডুবল যেন, একে একে প্রেমিকারা গান হয়ে যায়। রিমোটে আমি নম্বর বদলাই, চন্দনাদির রাধারমন শুনি, আমার প্রবল জ্বর, ঢাকার একরত্তির ঘর, তার বাইরে জটাজুট অন্ধকার নাছোড়বান্দা শিল্পীর হাতে পড়ে হয়ে দাঁড়াচ্ছে নেহাত এক জোসেফ বয়েজের আমগাছ, মুকুলিত ও মুখাবয়বে। জানি আজ তুমি আসবে-একঘেয়ে লুপে রাধারমন দুই-একবার বিরক্ত হয়ে লুকিয়ে পড়েন লোডশেডিং এ, তাই আমগাছের মুখ ভার। তুমি এলে যাওয়া যাবে পুরানো ঢাকার দিকে, জানি আজ তুমি আসবে না। তবু একা জরাগ্রস্থ পথে হেঁটে যেতে হবে আজ, কল্পনা বোর্ডিং এর পর ডান হাতে রাস্তায় ঢুকে গেলে জমাটি কীর্তনের অলীক আসরে ছোট ছোট ১৪/১৫’র দুটি মেয়ে তালিম নিচ্ছে, দুই এক কলি গেয়ে বা দোহার ধরে দুলতে দুলতে তারা পাকা কীর্তনীয়ার সঙ্গে, আর ইতিউতি চায়, সেই বুড়ো-বুড়ির দঙ্গলে দুই এক পিস যৌবন সেলফোন চিকমিক করলে কোন একটি বোন ফটো ফিনিশে পুর্ণাঙ্গ শ্রীরাধিকা হয়ে উঠবে যেন, এভাবেও বেড়ে তোলা যায় দেশ, নদী ও ছোটবোনটিকে সযত্নে সরিয়ে রেখে, অগোচরে আজও।