Wednesday, February 10, 2016

শেষ গোল্ডফিশ



নৌকা উল্টে যাওয়ায় তরমুজরা জলে ভাসছে। সারা ফ্রেম জুড়ে ডোরাকাটা তরমুজ ছড়িয়ে। নৌকাটা ধীরে ধীরে ডুবছে। প্রবল বৃষ্টি নামে। তরমুজরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। অনেকগুলি প্যারাসুট ভাসছে। বরফির মত লোকজন , নিপুণ দক্ষতায় ছোরা ছুঁড়ে সবকটা তরমুজ রক্তাক্ত করে দেয়। ছিন্নভিন্ন তরমুজগুলি ডুবে যাচ্ছে। গোল্ডফিশেরা দৌড়ে পালায়।




একটা ফিশিং বোলের মধ্যে একটা গোল্ডফিশ। জল না থাকায় ছটফট করছে। মিক্সির ট্রান্সপারেন্সিতে ঘুরছে তরমুজ। মেজারিং সিলিন্ডারে করে ফিশিংবোলে তরমুজের তরল ঢালে সাদা কাঁচের চুড়ি পরা হাত। তারপর গোল্ডফিশটাকে তুলে ১৪ দাগ ইনসুলিন পুশ করে তরমুজের তরলে ফের ছেড়ে দাওয়া হয়।




একটা গোল্ডফিশ ডিসেকশন ট্রের উপরে ছটফট করছে। একটা লোমশ হাত ইলেকট্রিকের করাত দিয়ে গোল্ডফিশটাকে সরু সরু করে কাটছে। টুকরো গুলো নিয়ে একটা হোয়াইট বোর্ডে বোর্ডপিন দিয়ে দিয়ে গাঁথা হচ্ছে। বিভিন্ন টুকরো থেকে হোয়াইট ববোর্ডের উপর বৃষ্টিমাখা কাঁচের মত গড়িয়ে নামছে রক্ত।




বেনারসের ঘাট। অনেকগুলি ধর্মগ্রন্থ জড়ো করা, পোড়ানো হচ্ছে। চিতার উপর বড় বড় কড়াই, মোম গলানো হচ্ছে। ঘণ্টার ভেতর মোম দিয়ে সীল করে দেওয়া হচ্ছে, গেরুয়া পোশাক পরে কতগুলি যুবতি হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে কড়াই থেকে গলানো মোম এনে সার করে রাখা উল্টানো ঘণ্টাগুলির মধ্যে ঢালছে। সঙ্গে সঙ্গে জমে যাচ্ছে তা ।




কতগুলো যুবক উলঙ্গ হয়ে গুলতি ছুঁড়ে খেলনা প্যারাসুট ওড়াচ্ছে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে তারা , সবুজ পাহাড়। একটা হামানদিস্তায় একটি হাত সাদা কাঁচের চুড়িগুলি খুলে রাখে। একটি লোমশ হাত কাঁচের চুড়িগুলো গুড়ো করতে থাকে। কাঁচের গুড়ো মেশানো হচ্ছে গলন্ত প্যারাফিনে। একটা বিশাল আকারের গোল্ডফিশে সেই কাঁচগুড়ো দেওয়া প্যারাফিন মাখাচ্ছে এক বৃদ্ধ তিব্বতি সন্ন্যাসী। পরনে মেরুন উত্তরীয় হাওয়ায় উড়ছে ফটফট করে । গোল্ডফিশটা ছটফট করছে। খালি পায়ে পাথরের উপর টালমাটাল বৃদ্ধ। পাহাড়ি নদীতে মাছটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।


http://www.guruchandali.com/blog/2015/05/06/1430894193633.html?author=karubasona

Thursday, December 04, 2014

আঘ্রাণের অনুভূতিমালা



পৌষ নতুন ধানের গন্ধ আনে না বরং গান্ধির হাজারি গন্ধের গোলাপি আলোয় আমরা পোড়াই রাত্রির মনোবাঞ্ছা সদ্য পড়া কুয়াশায়। আমি শহরে থাকি। মাথার মধ্যে থ্যালামাস আর চুল শিরা গলি ওয়ানওয়ে আর বাইপাস। রাত বাড়লে যদ্যপী দাপাদাপি আর কী সব করে জীবন কাটাই সেই বুঝিবা ট্রাফিক সিগন্যালের সা-রে-গা-মা আলোকসূচকগুলি। এর পরে কী করে আর বোঝাই আঘ্রাণের কথা। সে সরে সরে যায় নীরবে দূরে। আলোকঝঞ্ঝায়, পশ্চাতে ধায়, হায় হায় রে, সুন্দরী মলুয়া ডুবে যাচ্ছে নদীতে, মলুয়ে হায় হায় রে। উত্তর দিনাজপুরের একটি ক্ষেতের পাশ দিয়ে গেলে দৈবাৎ, মনে হয় পায়েস রান্না হচ্ছে অনন্তের পাকশালে। ধান পাকতে শুরু করেছে। কৃষকেরা কাজে। আমার সঙ্গে ছিলেন দেবাশিস বাবু। তিনি ওই অঞ্চলের লোক নন। শান্তিনিকেতনী প্রভাবে নুব্জ, ধান বলতে, বাসমতি, আহা, উচ্চারণেই তার চোখ ও মুখ উদ্ভাসিত হয়। আমার নাক তবু বুঝি জেগে আছে আজও, এইরকম ফাৎনাবৎ। আমি ধান থেকে ধ্যানে চলে গেছি। সেই চালটির নাম ছিল চিনি আতপ। সুগন্ধ পরিসরে ছড়ায় জ্যামিতির মত। সেই যাত্রায় কিনেও আনি কিছু কেজি রায়গঞ্জের চাউলপট্টি থেকে। তার পর আবার কোনও মেলায়, আবার। বাংলাদেশের পোলাও এর চাল বলে কিনতাম ভারী নিপুন দেখতে চিনিগুড়া তার সঙ্গে কোনও মিল নেই বহিরাঙ্গে। এর আলাপ ও বিস্তার অন্যত্র, সে গন্ধে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে, এই চাল শ্রীরাধিকার মত।




বাংলাদেশে থাকতে আমার রোজগার খাওয়ার জন্য কিনতাম যে দেশি চাল তার নাম বাঁশফুল। ঘোলাটে রঙের অসচ্ছ চাল। ঢেঁকি ছাটা না হলে পেপার হোয়াইট। তাতে জল ঢালে ও ধোয় জীবানানন্দের কোন কিশোরী হাত, এমনটাই ভ্রমে আমার অনেক সন্ধ্যে কেটেছে। বেটে বেটে চালগুলিতে জল ঢালতেই তদের চেহারা বেলফুলের মত হয়ে যেত, রান্ধলে মুক্তা। গুরুপাক খাওয়ার জন্য কিনতাম কালোজিরা চাল। চিনিগুড়ার থেকে আমার বেশি পছন্দ এই চাল হ্যাঁ গন্ধের কারণেই। বিন্নি এলে রান্না ঘর এমনিতেই আলো হয়ে যেত। সাদা বিন্নি আসত চট্টগ্রাম থেকে। লাল বা কালো কেনা হত প্রবর্তনা থেকে। আমি নিজে যেতাম না, তিলক বিশ্বাস বা তামান্না নিয়ে আসত। চালটা দেখতে ঘুবই ঘোলা, যেন একরাশ কাঁকর, একটা চালও বুঝি গোটা পাওয়া যেত না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা। তার সুবাসে কেবল কাব্যই হয় সুতরাং বিরত থাকলাম এই যাত্রা তার রূপকথায়। বিরিয়ানীর জন্যে রাইফেল স্কোয়ারের সেনাবাহিনীর দোকান থেকে আনা হত দিনাজপুরের চন্দনচূড় আর কনকচূড়। মেলা দাম, লোকজন বিশেষ কিনত না- সপ্তাহে দুই একজন খরিদ্দার, পরে জানলাম দোকানটাই উঠে গেছে। এইসব চাষ-বাষ সবই উঠব উঠব করছে। বন্ধু-বান্ধব যারা খেয়েছে তারা প্রসংশা করলেও নিজেরা আর বুঝি কিনে খায়নি, মাংসতেই তারা অধিক আগ্রিহী হয়ে থাকবে বিরিয়ানী প্রযোজনায়। দুটি চাল জ্বালে দিলেই দুধ হয়ে বেরোত, সে অপার্থিব সুগন্ধের রাজ্যপাট। আমি জানিনা ইলিশ বিরিয়ানীর জন্য এই চন্দনচূড় চালের কোন বিকল্প ফটোশপ বাদে অন্যত্র থাকবে কিনা।




কেউ কেউ চাল নিয়ে আসে। গান খুঁজতে গিয়ে বাপ্পাদা নিয়ে এলো কালানুনিয়া আর চালওয়ালার ফোননম্বর। যাওয়ার আগে যেন বলে যাই, সে রেডি করে রাখবে। সরসমেলা থেকে আসে তুলাইপঞ্জি। ডিয়ার ডিএ র জয়ন্তবাবুর ফোন নম্বর দেয় এক বালুরঘাটের লোকশিল্পী। কুড়ি পঁচিশ যা লাগবে জানিয়ে গেলে ভাল। বেশি তো কেনা যায় না, রাখাই যায় না এইসব সুগন্ধি চাল। পিঁপড়ে থেকে পোকা সবই লেগে থাকে পাপক্ষয়ের মত। আমার অসম বয়সের এক বন্ধু শ্যামল বসুমাতারি আমার ধান-চাল নিয়ে উৎসাহ আছে জেনে টানা আট-দশ ঘন্টা আমায় বিচ্ছিরি রাস্তায় বাইকের পেছনে নিয়ে চাল দেখিয়ে বেরিয়ে ছিলেন বছর দুই-তিন আগে। চলতে চলতে আলিপুরদুয়ারে জয়ন্তি পেরিয়ে কামাক্ষ্যাগুড়ির কাছে দেখা পেয়েছিলাম স্বর্ণমস্রি আর কালাননিয়ার। সেই যাকে বলে ধান্যক্ষেত্র, বিজন ভট্টাচার্ষের মত বললেন শ্যামলদা। একমাত্র ছেলে মারা গেছে বছর পাঁচ বাইক দুর্ঘটনায়। তার বাড়িতে আমার সর্বক্ষণের দাওয়াত। কালানুনিয়া খাইবা শুকর দিয়া আর শুয়ে থাকবা ঘরত, গান-বাজনায় কাটাবা জীবনটা। কোনওবার ২৫ ডিসেম্বরের যা বাজা্রের বহর থাকে, তা শুনেই আমি স্তম্ভিত, ফোন করি ডিসেম্বরের শুরুতেই, আয়োজন সব ঠিক আছে তো। খান তিন শুয়োর- যা তিনবাড়ির লোকে সাতদিনে খেয়েও নাকি শেষ করা যায় না! আর আছে ডানা মেলা পক্ষীরাজ বা পিপলিভাঙ্গ ধান যা নাকি ফলতেই চায় না জমিতে- কসরতের বর্ণণা শুনি, হাসি লুকিয়ে। তা সমৃত সুলভ ভাত কেবল খাওয়া হয় এই পরবের দিনগুলোয়। আমার আর যাওয়া হয় না বছরশেষের উৎসবে। কলকাতায় বসেই গন্ধ পাই বিশ্রুত নামের প্রায় নেই হয়ে যাওয়া এই সব ধানের। ভাত ফোটার গন্ধ পাই মেঘে ঢাকা তারার নিশ্চুপ আকাশে। কেউ আলিপুরদুয়ারে যাচ্ছে শুনলেই তাকে দিয়ে দিই শ্যামলদার মোবাইল নম্বর। বারেবারে বলি একটিবার যেও। শ্যামল দাকেও ফোন দিই। তিনি চালের প্যাকেট করে দিন গোনেন, বন্ধুর বাড়ি মেলা দূর, এই শহর কলকাত্তা, যেখানে পৌষ কোন গন্ধ নিয়ে আসে না। কেউ তাকে ফোন দেয় না। যে যার মত ফিরে আসে বেড়িয়ে। হাতি গাছ-পালা বাইসন রাম-হুইস্কি নিয়ে উচ্ছ্বসিত কতগুলি সন্ধ্যা কেটে যায় আমার ক্লেদের শহরে।

আজি গুরুগৃহবাস সমাপ্ত আমার

ছেড়ে চলে যেতে হবে, কিমাকার এই মাংসল পৃথিবী, আজি গুরুগৃহবাস সমাপ্ত আমার। পৃথিবীর পরিখা বরাবর হাঁটছে দুই আচ্ছন্ন পাফরমার, যেন ঘড়ির দুটি কাঁটার ইশারা, তারা এদিক ওদিক ছুটে যায়, উদবাস্তু জ্যামিতি যেমন হয়, আর দিঘীভরা জল করে টলমল। জলঘড়ি। উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগের শুরু যেখানে, কেন মুখপানে চেয়ে আছ গো মা, নীলগাইটি এসে দাড়ায়, যে কদাচ নীল ছিল না। আকাশ ছিল, জল ছিল, অবকাশও ছিল বিস্তর হাঁটাহাঁটির মাঝে, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমাদের ঘড়ির কাঁটারা নিজে নিজে ঘুরত, নন্দন দুই নিচে জলতল ক্রমশ উঠত, মোবাইল বাজত, চাই মিং-লিয়াং ছবি তুলতেন উদবাস্তু আত্মার পরিমিতি।

তুমি এইভাবে ফিরে ফিরে আসো। গল্পেরা কিমা হয়। বরফের ঘরে আমাদের অভিমান ঝরা রক্তের মত শান্ত উদ্দিপনা নিয়ে ফিরে আসে। ডুমুর বৃক্ষের তলে উপাসনারত শমিক শেষ পেগটি নিশ্চিহ্ন হলে বাইকের পছনে উঠে বসে লি কং শেং এর মত, তখনই মেঘ ডাকে চাই মিং-লিয়াং পেটের পৃথিবীতে, সূর্য দেব অস্তমিত, হায় অভিনয় করে ওঠা সাংবাদিকটি চলে যায় রাত্রির গভীরে। সম্বল তিরিশটি কলের একটি লিস্ট। মেঘা চোখের কোণে হেসে ওঠে,ভারি অদ্ভূত তার পুজোর থালার পাশে দুটি গ্লাস, ৩০-৬০ বিভাজনে ন্যস্ত। মাছেদের পৃথিবী আজ চৌকো হয়ে গেছে। নির্বাক ধুপগুলি পুড়তেই থাকে সময়ের অস্থির আয়নায়, যদুঘরের বড়ঘড়িটির কাঁটা ঘোরাচ্ছেন লি কাং শেং আরও দুটি লাঠি বেঁধেছেন, কাঁটাদুটির মত। কাঁটাদিয়ে কাঁটা তোলার কথা আমার মনে পড়ে। জাফ্রি কাটা সবুজ পিঠের উপরে মুখটি ঘুরিয়ে এনে শ্রীময়ী বলে, আজ তাড়াতাড়ি যাই, আজ বয়ফ্রেন্ডের মায়ের জন্মদিন।

আমরা পাশাপাশি লালন করেছি এ যাবত সমস্ত হাঁটাহাঁটি। ঘড়ির দুটি কাঁটার মত। তারা কখনও ইস্টে গেছে কখনও ওয়েস্টে, আপামর মুরগির নীচে, যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করি রাত্রি নেমে এলে। সখ- আহ্লাদ, বাসনা ও প্রেমটির মত সমস্ত বাইনারি আজ কুঁকড়ে যাচ্ছে। লিফটের উপরে চড়ে বসে আছি, আগে পৌঁছাব বলে, সে গাড়ি সময়ের তাই সে চলে না। উপত্যাকা। মগ্ন তুষার পড়ে ধিরে ধিরে। দুঃসংবাদ আমাকে ভারি করে তুলছে প্রত্যহ ও টেলিভিশন। ক্ষিদের মত লম্বা হচ্ছে আমাদের আশা। সখের পোশাক বহনের জন্য দুঃশাসনরাও আজ নেই হস্তিনাপুরে, আমেরিকার কোন এক প্রদেশে কর্মব্যস্ত আমাদের পুতুলখেলার সঙ্গী-সাথীরা। দীর্ঘ শব যাত্রার একদা সঙ্গী ছিল যারা। পড়ে থাকল টানেল ভিশন। আর এই শহরে শিরা-উপশিরা জুড়ে নোংরা জলে ডুবে যাচ্ছে আমাদের ঘড়িগুলি। নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারি না কেননা জানালায় কোনও আলো জেগে নেই। আর হতবাক আয়নারা অস্থির। বড় পদ্মঘড়িটিতে শ্যাওলার মত ভাসছে বিন্দু বিন্দু ওয়াটার মেলন। কাঁটাগুলি এঁকে-বেঁকে তার দুটি শিং হয়ে গেছে আজ।

পৃথিবীর সব গান নিভে গেলে তবু কিছু আলো গান হয়ে ওঠে

তুমি মৃত্যুকে প্রশ্ন কর। হাতি প্রশ্ন করে, আলপিনও। একগাদা কেবল প্রশ্ন পড়ে থাকে, পাহাড়ের মত, আমুন্ডসেন সেখানে ফ্ল্যাগ ওড়ান। চাঁদ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। মাটির জল নিয়েও। প্রশ্নের মুন্ড-মাথা হাত পা গজায় এই ভাবে, সেও ঘুরে বেড়ায় রাজপথে। মানুষের মত। সেও অস্থির। আজ লোকাল ট্রেনে, তো কাল লক-আপে। সে দিন ও রাতের ভেতর, ট্রামের তারাবাজির ভেতর মেজরাপের মত অস্থির। কলাপাতার উপর ধুলো আঠালো হয়ে বসে, শার্টের কলারে বিষাদের দাগ, উল্টাতে না পারা আরশোলার মত, এই থেঁতলে দিলে তুমি- প্রশ্নদের। বাস্তব। বা আকাশে উড়িছে বকপাখি- রবিঠাকুর এখন সাদা ধোঁয়ার মত এক গান- অবয়বহীন- ইস্কুলবালিকা বৃষ্টির ভেতর দিয়ে গেলে তিনি ঘুরেও তাকাতেন না। এখন তোমার নখের ভেতর মৃত্যু। নীল আঙ্গুলে কাঁচ মুচ্ছ ট্যাক্সির জানালার। বট পাতা ভেঙ্গে তার সাদা আঠা বেয়ে উঠছে তোমার আঙ্গুলে, সেই হয়ে উঠেছে তোমার আই-লাইনার, তুমি সেজে উঠছ আলতায়, কেমন যেন তোমার জ্বীভে নীল দোয়াতের কালি- ছেলেবালার পায়েসের স্বাদ।  দ্যেলুজের প্রথম খন্ডের মত একটা মেঘ সাদা হয়ে আছে মেঘলা জানালায়, চোখ মেঘের মত বড় হচ্ছে বা হ্রদের মত, রেটিনা ক্রমশ ফুলতে ফুলতে উৎলে পড়ল দুধের মত। কালিদাস আওড়াচ্ছেন রঘুবংশম- খুব স্লো। কোন খোলা চুল ওইশ্বর্য রাই, ইষৎ ফ্যাট সমেত, তরুনী ইঞ্জিনিয়ার সীতার ব্যস্ততায় নেমে যাচ্ছে পাতালে, সম্প্রসারিত হচ্ছে মেট্রো- আর সেটা জ্যাকসেওনের মস্কোর মত স্লো।  তুমি মৃত্যুকে প্রশ্ন কর, থেমে থেমে- লিটার, মিটার, ফুট। সব বাড়তি, পাতা উড়ছে, হাওয়া বাড়তি, কাজেই সব প্রবল লাগছে এখন তোমার, ছাপাখানার শব্দে অসম্ভব গতি। মেগাস্থেনিসের বাড়তি যে সব নোট একদিন ইন্ডিকা হয়ে গেল- ঘাড় নাড়ছেন রোমিলা থাপার, আরকিমিডিস প্লবতা দেখাতে চৌবাচ্চায় ছুঁড়ে ফেলছেন চন্দ্রগুপ্তের মুকুট। বৌদ্ধ শ্রমণ যে পথে যান, সেই পথে ফেরেন না, ঘুরপথে এই নাকতলা, ওই কানপুর- কথাও মিনিবাস-গুগুল ম্যাপ-ক্লাস ফাইভের ভুগোল ক্লাসে ম্যাপ পয়েন্টিং, আমাদের পেকে যাওয়া চুলগুলি লুপ্তপ্রায় যৌবনের আশেপাশে কে যেন বসিয়ে দিচ্ছে জোর করে, সম্ভবত ইনিই ক্লদ মানে। হে উৎকীর্ণ শিলালিপি, হে ভালবাসার শহীদ কতিপয় স্তম্ভ, আমাদের প্রেমের গোরস্থানে ক্রমাগত উপগত পাতারা, হে পাথরের জন্ম-মৃত্যু লেখা রঙচটা এলিজি, শোনো হে স্বর্ণসীতা, আদিবাসী কিশোরী পদাঘাত না করলে অশোক গাছে ফুল ফোটে না, তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এমনটাই লোকশ্রুতি।

একদিন এক ট্রেন মৃত্যুকে প্রশ্ন করল। একদিন দক্ষিণের হাওয়া। একদিন এক দোয়াত কালি। একদিন উপলক্ষ্য। আলো এলো অদল-বদলের খেলা নিয়ে। জীবনানন্দ শুয়ে রইলেন ঘাপটি মেরে - দ্যাখাই যাউক শিশিরবিন্দুকে কতখানি বড় মনে হয় সূর্যের চেয়ে। সমস্ত বিষাদ কচুকাটা করে দেশে ফিরে গেলেন লর্ড ক্লাইভ- তোরা বিষাদঘোটক আর তোরা সিন্ধুঘোটক।  বেহালাটা মাটিতে নামিয়ে নিজের শার্ট রিফু করতে করতে উকিল মুন্সি একদিন বললেন, তুমি এইখানে এসে বসো, জলে হিজিবিজি দেখ, অনেক উত্তর আছে, মজা ব্রহ্মপুত্রে তখনও কয়েকটি এলোমেলো নৌকা।  তাকালে ঝিম ধরে আসে। নৌকা প্রশ্ন করতে লাগল। বেহালাও বেজে ঊঠল অনেক প্রশ্ন নিয়ে। সূঁচ-সুতা সবাই চিৎকার করতে লাগল খালাসিটোলায়, নিউদিল্লী স্টেশনের শব্দ, আনাতোলিয়ার আদালতে- উঠোন জুড়ে কেটে ফেলা চুল,  চুম্বন স্মৃতির ঘরে উড়ো চিঠি, রেল লাইন বরাবর চায়ের ভাঁড় সবাই প্রশ্ন করতে লাগল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

Monday, February 13, 2012

কিছুই যখন রইল না আর

এদিক ভাঙছে নদীর পাড়, শহরে নতুন হরাইজন, ফিরছে শীত এই বসন্তে, একলা লাগছে ঘোর জঙ্গলে, কয়েকজন আর কয়েকটা রাত, ফরেস্ট বাংলো, খড়ের বিছানা কেটেই গেল কয়েকটা রাত, ডাবের জলে বসন্ত দাগ। এমন কথা লিখছি বসে, হাজার বাস, আর ট্রামের তারে, ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়ার ট্র্যাকে লিখছি এখন ইউনিকোডে।
যখন কিছুই রইল না আর, কয়েকটা বই কয়েকটা হাত, হারিয়ে যাওয়া কয়েকটা ছাতা। হারিয়ে যাওয়া শহর আমার ডট পেন আর কলিকাতা, কয়েকটা শালিখ, কয়েকটা খাটাল, চুড়ির হাতে রঙমশাল, আগুণ ছিল ঠিক লুকিয়ে গাছের পাতায় ঋতুর গানে, ইতুর সরায় মটর ছোলা, থুতু মাখা চুল আর অভিমানে। অমিতাভ-রেখায় হারিয়ে গেল চায়ের দোকান, পাড়ার স্বপন, নতুন সেলুন, বাইক-টাইক ঠিক জুটিয়ে, চলল যেন সপ্তপদী, এই তো হুস, তোমার জলে আলতা ফেলে, ব্যস্ত গোপাল পরকীয়ায়, উঠোনজুড়ে লংকাজবা আর একমাথা সেই টগরফুলে। এই তো কটা খবর কাগজ, কটা চোখ আর দু-একটা বছর, এই ভাড়াটে এল গেল, আর ঠিক কেমন ঘুরতে যাওয়া, ঠিক জুটে যায়, সমুদ্র-পাহাড়, চাওয়া-টাওয়া, ডাস্টবিন আর এঁটোকুকুর, টবের গাছে নয়নতারা।
আজকে যখন, শহর ছেড়ে অনেক দূরে, যাচ্ছি ফেলে, গাঁদা ফুল আর গানের খাতা, একটু ধুলো, প্ল্যাস্টিকেতে বাঁধাছাঁদা, না খেলা আবির, ঊঁইকাটা বই, কালি চুপসে উৎসর্গপাতা, ভুলতে বসা গানের কথা, উড়ো খই আর বাজে খেউড়, যে সব গাছে আজ ফুল ফুটেছে। শহর গেল মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে, দু-একটা গাছ তবু শিমূল-পলাশ, হিমঘরে আলু কাটাছেঁড়া লাশ, সব কিছুর পাট আবার তুলে, যারা সেইসব বন্ধুছিল, কয় বোতলে কয়েক সুজন, সজনে গাছে খয়েরি আঠা, নীল আকাশে শিমূল তুলো।
কিছুই যখন রইল না আর, কয়েকটা চিঠি, আলতা বাটি, ধানের ভিতর ভিটে মাটি, দুয়েকটা দেশ, ভাঙ্গা জাফ্রি, ট্যাক্সি জুড়ে না বলা কথা, ঘুমের নীচে শীতলপাটি। দিনের শেষে, দিদির বাইট ঝাপসা আলোয় ট্রাফিক লাইট, এসেমেসে হেসে মেসে, চলল কিছু খুনসুটি আর মাথার শিরায় গ্লো সাইন, একলা খাবার একলা বাড়ি, আয়না জুড়ে মস্ত ধুলো, মেয়েরা সব ম্যানিকুইন।
এখনও কিছু আছে পড়ে, মাংকি ক্যাপ আর মিস্ট্রি-কেমিস্ট্রি, সুরকি ওঠা পুরানো বাড়ি, তিলের খাজা গুড়োগুড়ো, সর্ষে ক্ষেতে একলা হয়ে, ভেলভেলেটা কাকতাড়ুয়া, টাই-কোর্ট আর ধড়াচুড়ো। অফিস মানে দৌড় ট্রেন ধরতে, বাজার না যাওয়ার নতুন ছুতো, নতুন গুড়ে কয়েকটা মাছি, নদীর চরে কয়েকটা ট্রাক, চুল মাথা সব বালি বালি, ঘনঘন সব দেশলাই পোড়ে, বাকশো সাজাই শহর জুড়ে, যে সব ছিল শান্ত ডোবা, দু একটা শোল খলসে পুঁটি, কপাল জুড়ে কচুরিপানা, মধ্যে দুদিন ক্রিকেট খেলা, এই বসন্তে নতুন মানুষ, ওই তো দেখি নতুন মেয়ে রোদের ভেতর নামতা ভুলে ফেসবুকেতে, বুক ঠুকেছে, এই বছর ঠিক জুটিয়ে নেব গঙ্গারামকে পাত্র পেলে।