Monday, May 02, 2011

টিলোস রেডিও, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে

যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়রি রৌদ্রের দিনে আমার টিলোসে প্রবেশ, যখন হাঙ্গেরীয় অর্থে টিলোস, নিষেধ। বুদাপেস্ট শহরে এখনো বসন্ত এই এলাম এই এলাম করছে, এবেলা রোদ তো ওবেলা বৃষ্টি, তার মধ্যে টুকি দেওয়া ফুল এবং টিলোস রেডিও। নিচে একটা ছোট্ট বার, পাশে কুড়ি আসনের সিনেমা হল, বাইরে যে সব পোষ্টার লটকে আছে তাতে ফিল্ম সোসাইটি গোছের হাওয়া। তারপর দুকদম এগোতেই অন্ধকার।টিলোস টিলোস অন্ধকার, কিম্বা যে আকাশে কাস্তের মত বাঁকা চাঁদ ওঠে - ডুবে যায়, কানে এল, হ্যাঁ বন্ধুগন, অরুন্ধতি রায়ের কন্ঠ! ইংরাজি ভাষায়। ... সিমিলার্লি ইন ইন্ডিয়া নট হান্ড্রেড্স বাট মিলিয়ন্স ও আস উড বি অ্যাশেমড অ্যান্ড অফেন্ডেড ইফ উই ওয়ার ইন এনিওয়ে ইম্পলিকেটেড উইথ দ্য প্রেসেন্ট ইন্ডিয়ন গভমেন্টস ফ্যসিস্ট পলিসিজ হুইচ অ্যাপার্ট ফ্রম দ্য পার্পেট্রেশন ওফ স্টেট টেররিজিম ইন দ্য ভ্যালি অফ কাশ্মীর ইন দ্য নেম অফ ফাইটিং টেররিজ্ম হ্যাভ অলসো টার্ণড ব্লাইন্ড আই টু দ্য রিসেন্ট স্টেট সুপার্ভাইজড প্রোগরাম অ্যাগেনস্ট মুসলিম ইন গুজরাট। ইট উড বি ওবসার্ভড টু থিংক দ্যাট দোজ হু কৃটিসাইজ দ্য ইন্ডিয়ান গভমেন্ট আর অ্যান্টি ইন্ডিয়ান, অলদো দ্য গভমেন্ট ইটসেলফ ইটসেল্ফ নেভার হেসিটেট টু টেক দ্যাট লাইন...আমি ঠোক্কর খেতে খেতে উপরে যেতে থাকি, সন্দেহ নেই, টিলোস রেডিওতেই পৌঁছেছি।

ঘরে আলো খুব কম, দেওয়ালের রঙ সাদা নয়, কেননা সার দেওয়া গ্রামাফোন রেকর্ডেরাও ঢেকে গেছে পোস্টারে পোস্টারে এবং আলো সত্যিই খুব কম। শেষ হয় অরুন্ধতি কন্ঠ বিস্তর কূটকচালির পর, যার সবটা আমার পক্ষে এখানে দেওয়া সম্ভব নয়, তবু শেষটুকু দি, কেননা আমাদের কাছে ভাষা ছাড়া কিছুই নেই প্রমাণযোগ্য। শেষে স্লোগান সমবেত হয় ও সকলে উঠে দাড়ায়... ইন এবিলিটি টু সি অ্যা ওয়র্ল্ড ইন টার্মস আদার দ্যেন দোজ দ্য এস্টাবলিশমেন্ট হ্যাজ সেট আউট ফর ইউ, ইফ ইউ আর নট বিশি, ইউ আর তালিবান। ইফ ইউ ডু নট লাভ আস, ইউ হেট আস। ইফ ইউ আর নট গুড, ইউ আর ইভিল। ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর টেররিষ্ট।... সেদিন শনিবার সকাল, তখন ও কানে আসেনি নন্দীগ্রাম, এক ঘন্টা ভারতীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান এবং সেখানে গেলে দেখা পাব এক ভারতীয় বন্ধুর, এর বেশি কিছু ভাবিনি! সকলে চেঁচাচ্ছে আর সেটা সম্প্রচারিত হচ্ছে সারা বুদাপেস্টে। পরে, আলাপ হওয়ার পরে, জেনেছি এদের নব্বই শতাংশ ইংরাজি জানেনা তবু তারা চেঁচায়, তবু চেঁচায়, তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।


বেলা অতিক্রান্ত, প্রচুর বিয়ারের পর ক্ষিদে অন্তরহিত,স্বর্গে পৌছাবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিল ভুলে, ভারতীয় সংগীতের অনুষ্ঠান বহু বহু আগে শেষ, কখন ও শুনছি অদ্ভূত সব গান কখনো কথকতা, প্রতিটাই অবশ্য স্লোগান হয়ে যায়, আমাদিগকের ভাষা কি সলোমানের বিচার? ৯০.৩ হাংগেরীর সর্বাধিক প্রচারিত রেডিও নয় হওয়ার কথাও নয়, কিন্তু মজাটা এইখানে যাদের বয়স কুড়ি থেকে তিরিশ তাদের আশি শতাংশ এই রেডিওর ভক্ত। যেখানে কোন বিঞ্জাপণ নেই, ভণিতা নেই, কেবল কন্ঠ ছাড় জোরে। সুর ভাসে বাতাসে পরক্ষণেই তা চাপিয়ে যায় কন্ঠের প্রবলে দেখা যায় ভাষা ভিদেশী হলেও একে একে যুক্ত হতে থাকে বন্ধুরা, সানাইয়ে সংগীত যন্ত্রে ট্রিস্টানের নবম সিম্ফনি/ কতদূর যাবে, এ যে ঢের বড় সমুচ্চ বিহার/ সেনেটের শত প্রান্তে মেথি খোঁজে ইঁদুরের শ্রেনী, হ্যাঁ বন্ধুরা আমি গলা মেলাতে থাকি, আই অ্যাম পাল্স বলে চিনা সংগীতে বা দক্ষিন আফ্রিকার, রেবেল মিউজিকে, আমি যেন অনেকদিন পরে চেঁচাচ্ছি, আর আছড়ে পড়ছি অন্য ইতিহাসে, হ্যাঁ বন্ধুরা এখানে বসেই বাঁশি নামিয়ে এদের সাথে গলা মিলিয়েছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, ও হরি তিনি কেন? বন্ধুরা আমার মুখের দিকে তাকায়, কেন? কেন? কেন? না, আমার বেশ লাগে, আমিও তো নত মুখে হেঁটে যাই রোজ, ভাঁজ করে রাখি খবরের কাগাজ রোজ, সহসা পাল্টে যাই চ্যানেলে চ্যানেলে, এই তো ভাল, চেঁচিয়ে নিলাম একটু!


গত দশ বছরে মাত্র একবারই পুলিশ বন্ধ করেছিল ছয় মাসের জন্য, টিলোস রেডিও। তাও নিতান্তই ধর্মীয় কারণে, কেউ গালমন্দ করেছিল জিউসদের। প্রায় দুহাজার লোক এখানে পালা করে অনুষ্ঠান করেন, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার অত্যাচারিত মানুষ, রজার ওয়াটর্স থেকে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, হ্যাঁ বন্ধুরা, এদের অর্থানুকূল্যেই চলে টিলোস রেডিও, কন্ঠ ছাড়ে জোরে, ইথারে ইথারে,আর আমাদের? আর আমাদের? আর আমাদের? দু:সাহসি কেউ নেই যে এসে পেচ্ছাপ করবে মুখে/ জানে কামড়ে দেবো, জানে অংগহানি হলে বুদ্ধদেব/কে পুনর্গঠিত করবে পাগলা রামকিংকর বেজ চাড়া?/ জীবনেই একবার শিল্প-অনুরাগিনীর কাছে/ ন্যাংটার উদ্ধৃত অংশ হাতড়ে বলেছিলুম, কী ভাবেন/ শিল্পই যথেষ্ট? কেন কার্তুজ লটকানো হলো দেহে?... না বন্ধুরা একথা আমি আমি বলিনিকো, সেই যে শক্তি চাটুজ্জে সে বলেছিল, আমার কোন দোষ নেই, স্যার, আমাকে মারবেন না। 



প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচন্ডা৯'র বুলবুল ভাজায়।
দেখুন এইখানে


টিলোস রেডিও শুনুন এইখানে

আত্মহত্যার অধিকার

আঁধার সম্যক কৃষ্ণবর্ণে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে রঙ্গীন সূচিশিল্প, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। এই ভাবে নিজেকে নিজে আস্বস্ত করি, এমনটাও কানে আসে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। মুস্কিলটা হচ্ছে এই পাপ-ফাপ যেমন বুঝি না তেমন এটাও বুঝতে পারি ক্রমশ আত্মহত্যাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, সকলেই এগিয়ে চলেছি সেই লক্ষ্যে। সুতরাং আখ্যান আরম্ভ।


১৩ই এপ্রিল ২০০৬ আমি জানতে পারি আমার নয়জন বন্ধু আত্মহত্যা করে ফেলতে পেরেছে, এরা সকলেই পোলট্রির ব্যবসা করত। কেউ পশ্চিমবঙ্গে কেউ অন্ধ্রে,কেউ মহারাষ্ট্রে । এরা সকলেই আত্মহত্যার সুযোগ খুঁজছিল। এইচ পাইভ এন ওয়ান আভিয়ান ফ্লু নামের এক ভাইরাস আসায় এদের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি। সারা ভারতে ১২৩,০০০ পোলট্রি চাষিদের মধ্যে নাকি সত্তর শতাংশের অবস্থাই মারাত্মক। মুরগী বিক্রি যখন রাতারাতি পড়ে গেল তখন তারা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে চেষ্টা করে ছিলেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার।



ভেঙ্কান্না রামান্না রাই, একদা গুন্টুর বাসি একুশ বছরের উজ্জ্বল তরুন, এসেছিলেন বিদর্ভে। ২০০৬ এর ২রা ফেব্রুয়ারী কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ভুমিহারা এই চাষি চাষ করতেন অন্যের জমিতে। উন্নত ফলনশীল বীজ ও কীটনাশকের প্রভাবে এই বছর লঙ্কার উৎপাদন হয়েছে প্রচুর। ২০০২-২০০৩ সালের থেকে দাম দাঁড়িয়েছে ঠিক অর্ধেক। নাগপুরের ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে তা ঠিক করেছেন। ভেংকান্না লিজে ৪৫০০ টাকা প্রতি একর হারে জমি নিয়ে ছিলেন নয় একর, এছাড়া বীজ। কীটনাশক, বিদ্যুত, যানবাহনে খরচা হয়ে ভেঙ্কান্নার ঋণের পরিমান দাঁড়ায় ৬০,০০০ টাকা। ফসল উৎপন্ন হওয়ার পর দেখা গেল তার দরকার ২০ কুইন্টাল শষ্য। অর্থাৎ তিনবছর। এর থেকে আত্মহত্যা নিশচিত সহজতর। বিদর্ভে এই চাষ- মরশুমে যে ৩৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন তার তালিকায় ভেঙ্কান্নার নাম নেই কেননা তিনি তো তেলেগু চাষি। পান্ধরকাওড়া সাব ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালের লগবুকে ভেঙ্কান্নার নাম নেই, অথচ তার পোষ্টমর্টেম সেখানেই করা হয়েছে।

কয়েক মাস যাবত মিডিয়া অন্ধ্র ও মাহারাষ্ট্রের গুচ্ছ গুচ্ছ আত্মহত্যার ঘটনা ছেপে চলেছে। এর কারণ না কি অর্থের স্বল্পতা। এটা হয়ত বা ঠিক , কিন্তু পুরোটা নয়। আত্মহত্যা খুব সহজাত ঘটনা, আকছারই হয়ে থাকে, নানাবিধ কারণেই। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কারণেও হয়ে থাকে সে সব আমরা সকলেই জানি। হুএর কথামত আত্মহত্যার বিশ্বব্যাপী হার ১৪.৫ প্রতি লাখে। সেখানে ভারতে জনসংখ্যার হিসেবে দাঁড়ায় ১৪৫০০ জন প্রতি বছরে। গল্পটা সেখানে নয়,ভারতে ঠিক যতগুলো আত্মহত্যা ঘটে তার অধিকাংশেরই হদিস থাকে না, বস্তুত এটা একটা অপরাধ। ২০০০ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো নথিবদ্ধ করেছে ১০৮,৫৯৭ টি আত্মহত্যার ঘটনার। অর্থাৎ ভারতে আত্ম্যহত্যার সংখ্যা প্রতিদিন তিনশটি বা প্রতি পাঁচমিনিটে একটি।

মজার কথা হচ্ছে রেকর্ড ঘাঁটলে পাওয়া যাচ্ছে ভারতে আত্মহত্যার মূল কারণ দারিদ্র নয়, বেশীর ভাগ কারণ অসুস্থতা,বার্ধক্য, একাকীত্ব, সাংসারিক ঝামেলা এবং বিবিধ ক্ষুদ্রাতীত ঘটনাবলী। দারিদ্র এই তালিকার শেষ দিকে আছে। কেননা রেকর্ডে আছে সারা বিশ্বে ষাটোর্ধ মানুষ ও ১৫- ২০ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার মোট হারের ঠিক তিনগুণ। যারা বস্তুত আয়ের হিসেবে নেই। ফলে খুব কম আত্মহত্যাই দারিদ্রের কারণে ঘটছে, এটা বলা হচ্ছে। ভারতে যে পন্ডিচেরীতে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী, ৫০.৮৫ প্রতি লাখে,সে দারিদ্র সীমার ধারে কাছে নেই।

এউ এস এ আত্মহত্যার হার ১৩.৯ প্রতি লাখে। রেকর্ড বলছে সেখানে সাদা দের আত্মহত্যার হার কালো দের থেকে বেশী। টিনএজদের আত্মহত্যার হারও প্রচন্ড বেশী । উন্নত দেশগুলোর চাইতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের আত্মহত্যার হার কম। এর প্রধান কারন হয়ত জনসংখ্যায় মুসলিমদের প্রাধান্য,ইসলামে ঐ পাপের ফান্ডাটা বেশ জোরদার এবং তারা সেটা বিশ্বাসও করে। সারা পৃথিবীতে মহিলাদের থেকে পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশী প্রায় তিনগুণ যদিও দারিদ্রের হার ও নির্যাতীতের হারে মহিলারা অনেক এগিয়ে পুরুষদের থেকে। সুতরাং এগুলো বারে বারে প্রমাণ করছে আত্মহত্যার সাথে গরীবদের ও নির্যাতীতদের যোগ কম।



সম্প্রতি অনুরাধা বোসের একটি লেখা থেকে জানা যাচ্ছে ভারতে সর্বাধিক আত্মহত্যার হার ১৫-১৯ বছর বয়সী তামিল মেয়েদের মধ্যে ১৪৩ প্রতি লাখে যা প্রায় বিশ্বের আত্মহত্যার হারের দশগুণ। অনেক সময় মিডিয়ার লেখালিখিও আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়,অধ্যাপক দিনেশ মোহনের এই ব্যাপারে একটি সুবিস্তৃত লেখা আছে, ১৯৯০ সালে ম¾ডল কমিশনের বিরুদ্ধ প্রতিবাদে কি ভাবে আত্মহত্যা সংক্রমণের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সংবাদে প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে। এদের সকলের বয়স ১৫- ২৯ এর মধ্যে, যারা চটজলদি আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এত্ত সব হিসেব নিকেশ করে বলা হয়ে থাকে ভারতে দারিদ্রের কারণে আত্মহত্যা মোট আত্মহত্যার কেবল ৫ শতাংশ। ফলে যারা দরিদ্র তাদের আত্মহত্যার অধিকারও অনেক কম। নতুবা তারা সত্যিই আত্মহত্যা করেন না। কাজেই ভেঙ্কান্নার মত দু-চার জন ছুটকো-ছাটকাদের তালিকা থেকে বাদ দিলেও হিসেবে গরমিল হওয়ার কথা নয়।



প্রকাশিত হয়েছিল- গুরুচন্ডা৯'র বুলবুলভাজায়।
দেখুন এইখানে

ধান কাটা হল সারা

শ্রীচরণেষু মা,

এ বছরও পৌষ সংক্রান্তিতে বাড়ি যেতে পারলাম না। ভেবেছিলাম পুরুলিয়া যাব, দুয়ার্সিনির বাংলোয় সকাল থেকে দলে দলে মেয়েরা আসবে গান শোনাতে তারপর চলে যাব কাঁসাই নদীর ধারে, এলোমেলো পাহাড় চুঁইয়ে আসা আলোয় ঝলমলে ঘোড়ানাচ , একে একে রঙিনে রঙটানা টুসু বুড়বুড়ি কাটতে কাটতে ডুবে যাবে জলের তলায়, কন্যার বিদায় কখনই সহ্য করা যায় না। চোখ ফেটে জল আসে, আত্মীয় স্বজনদের বিয়েতেও তুমি লক্ষ্য করেছ আমি সেই সময়টা এড়িয়ে যাই। মেঘে ঢাকা তারার গানটা এত টুসুর ভেতরেও ভেসে আসে, কিন্তু বিজয়ার দিন তো কই আমার কান্না পায় না! মা গো, এত রহস্যের কিছু নেই, প্রতিবার বাড়ি থেকে আসার সময় আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা তা কেন আমিও জানি তুমিও জান।ধুস দেখ কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি, আসলে এই বছরও আমি যেতে পারব না, জানি বাড়িতে তুমি আর বাবা একা অপেক্ষা করে থাকবে, বাবা নারকোল ঝেড়ে পরপর সাজিয়ে রেখেছে, দোকানে আগে থাকতে বলে আনিয়ে রেখেছে অল্প অল্প দানা ওয়ালা ঝোলা নলেন গুড়, তুমি চল্লিশ বার বকুনি দেওয়াতে আতপ চাল ভাঙিয়ে এনেছে আর নিয়ে এসেছে ক্ষোয়া ক্ষীর। প্লিজ তোমরা পিঠে-পুলি সব করে খেও, দ্যাখো আমি ঠিক কবে যেতে পারবো এখনি বলতে পারছি না। পুরুলিয়া না গেলেও বাড়ি যাবো না। আসলে এবার পুরুলিয়া যেতেই চেয়েছিলাম, অনেকদিন নতুন ধানের গন্ধ পাই না তো মা, পোড়া মবিলের গন্ধে ঘাড় নিচু করে রাখি সবসময়। এমু যেতে রাজী হল না, তাই হয়ত সকাল বেলায় কেঁদুলি চলে যাব।


মা, তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। আমি হয়ত পালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কেন তুমি সেটা প্লিজ একটু বুঝ। আসলে আমি এইদিনে তোমাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। যখন ছোট ছিলাম তখন এতটা মনে হত না, বাবার লেপের ভেতর কোলের ওম নিয়ে নবান্নের গল্প শুনতাম। সে ওম আর রইলনা, গল্পেরা হারিয়ে যেতে লাগল। আমার বড় হওয়ার সাথে সাথে নবান্নের গল্প এক ঘেয়ে হয়ে পড়ে, যেমন বাবারাও বড় হওয়ার সাথে সাথে গৃহহীণ হয়ে পড়ে এবং নবান্নহীণ। আমার ছোটবেলা জুড়ে নতুন চালের গন্ধ ছিল না,গ্রামে থাকতে পছন্দ করতাম না, সোনার সীতারে হরেছে রাবণ পল্লীর পথ পরে'র চাইতে বেশী পল্লীকবিকে চিনতাম না। এদেশে আমাদের জমি নেই, তাই নবান্ন নেই, সংক্রান্তিতে কেবল পিঠে পার্বন। আমি জানি তোমাদের এখনও এটা মেনে নেতে ভীষণ কষ্ট হয়, আমারও তখন তোমাদের মুখের দিকে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হয়, আমি এড়িয়ে যাই, পালিয়ে যাই। তোমারা অন্য কষ্টের ভেতর বাংলাদেশকে লুকিয়ে রাখো।

আসলে মা, আমি না মিছিমিছি কষ্টপাই। এই দ্যাখো সিঙ্গুরে কতলোকের জমি একসাথে চলে গেল। সেখানে ফ্যাক্টরী হবে। এরকম এর আগেও গুচ্ছ হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। অনেকেই চড়া দামে জমি বেচেছে, টিভিতে আমি নিজে দেখেছি, তাদের হাসি মুখ, তারা বলেছে, এবার তাদের জীবন কত সুরক্ষিত, সুরক্ষিত তাদের সন্তানের ভবিষ্যত। পরপর দুদিন আসানসোল আর বর্ধমান গেলাম সিঙ্গুরের উপর দিয়ে, গিজগিজে পুলিশ ছাপিয়ে চোখে পড়ল সোনালি ধান। কাটা হয়ে গেছে, কোথাও স্তূপীকৃত কোথাও এলোমেলো। আমার তোমাদের মুখ বেশি মনে পড়ল, নিজের সন্তানকে নতুন ধানের গন্ধ না দিতে পারার কষ্ট নিয়ে সেই পিঠে- পার্বনের রাত, বাবার গল্পের মানে আমার কাছে ছিল পিঠের জন্যে অপেক্ষা, তুমি পিঠে বানিয়ে নিয়ে আসতে, আমাদের সেদিন ভাত-রুটির পাঠ থাকত না। আজ আমার সেই অপেক্ষাও নেই, কেবল পালিয়ে বেড়াই। এ বছর দ্যাখো কতগুলো বাড়িতে শেষবারের মত নবান্ন হচ্ছে। নতুন করে আর গল্প তৈরি হবে না তার সন্ততিদের জন্য। আচ্ছা মা, সন্তান কি খুব জরুরী? সে তো কেবলই তোমাদের কষ্ট দেয়, তাই না?



প্রকাশিত হয়েছিল গুরুচন্ডা৯'র বুলবুল ভাজায়।
দেখুন এইখানে

Monday, August 16, 2010

ঐ পারে থুতুগুলি এই পার টলমল


ছাড়া ছাড়া মেঘ অস্থির হয়ে উঠছে। পানশালায় কচ্ছপের মত উড়ে বেড়াচ্ছে ধোঁয়া। সামনে বিয়ারের খালি বোতল রেখে আমরা বন্ধুরা থুতু ফেলা প্রাকটিশ করছি, অনেক থুতু দিতে হবে চারপাশে। অনেক অনেক থুতু। পিককে তখন একে একে ঢুকছেন কবিরা, পিয়াসিতে গল্পকাররা, আরো এদিক-ওদিক টুকরো টাকরা প্রাবন্ধিক- ব্লগার কতিপয়। আমরা পিচকারির মত থুতু দিতে থাকি, যেন কোন ধর্মগ্রন্থের তর্জমা, শত-সহস্র-লক্ষ- অজুত-নিজুত ধারায় বইছে ভুবনে।

আমরা ক্লাব করলাম সভা সমিতি, ঠিক করলাম কবিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, দু-একপাত্র গল্পকার, আধ ফুট হিংস্র ব্লগার সব; এত থুতু কোথায় যে রাখি! নদীগুলি সব আমাদের ছিল, পদ্মা যমুনা মধুমতী। আমাদের শরীরে পুরানো সব গাছ শক্ত ও আশ্রয়, কত শত শত কাক দেখিছি আমি ভোররাতে উড়ে যাতে যাতে বলে গেছে তারা, তৈরি থেকো আর কবিদের বিশ্বাস করো না কখনও। তৈরি হয়ে বসে আছি সারাদিন, সারা শরীর জুড়ে থুতু আর পেছনে ক্ষমার অধিক রক্তাক্ত আকাশ। কোন কবি না এলে আমি আর কী করতে পারি?

আমাদের জানা ছিল না, নদীর অন্য পাড়গুলিতে কবি-গল্পকারেরা শুকিয়ে গুটিয়ে এট্টুস হয়ে পড়ছিলেন, চাইছিলেন মাটিতে মিশে যেতে। কিন্তু মাটি তাদের নেবে কেন? কোথা থেকে অদৃশ্য কিছু হাত এসে তাদের ফেলে দিল জলে, তারা টলমল টলমল পদ্ম-শাপলার মত। আমরা খবর পেয়ে পাড়ে এসে জড়ো হলাম। স্লোগান, উত্তেজনা ও লাইভ টেলিকাস্টের শেষে সার সার পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে থুতু ছুড়তেই থাকলাম। ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এল। আমরা বাড়ি গিয়ে খচাখচ অনলাইন পিটিশন বানালাম। পিডিএফ ও ফরোয়ার্ড, ফরোয়ার্ড। এবং চুপি চুপি তাদের বাঁচিয়ে রাখলাম, এত ঘৃণা ও থুতু কোথায় যে রাখি।

কবিরা পানির ভেতর চুপসে ছিল ভিজে বেড়ালের মত, গজগজ করছিল সেই দিগ্গজেরা, যেন পারলেই লিখে ফেলবে দু-তিনটা নিউজ পেপার আর দেখছিল নৌকার আসা যাওয়া, মাছেদের খেলা। কখনও চড়া রোদে কখনও ধুম বৃষ্টিতে তারা ডুবছিল ভাসছিল আর প্র্যাকটিশ করছিল নিজেদের মধ্যে থুতু ছোঁড়াছুড়ি। ঘৃনা তাদেরও ছিল, ক্রোধ ও দু-এক ছটাক থুতু। তবে তা কেবল নিজেদের জন্য, আত্মঘাতী, কাক ও পলের উপমা তখন দ্রবীভূত। আর নদীর অন্যপারে তখন মেলা, সাজগোজ রঙিন পোশাক খাবার-দাবার চ্যাট ও অনন্তসজ্জায় বিয়ারের বোতলগুলি, বিধিসন্মত।

Sunday, August 15, 2010

ভাষা যদি নাই থাকো কাছে


যদি নাই থাকো, নাই থাকো আকাশে ঘুড়িটি আর জলদগম্ভীর মেঘ, উমার কথাই বলি বা কেমনে! শিহরন অহরহ, হলুদে ভেসে যায় ঝিঙাফুল মাচা, বিন্দু বিন্দু সাদা গুলি বড় হওয়ার প্রবল চেস্টায় রত, কবেই আর মেঘ হবে তারা, ফিকে রঙের স্যালাইনের বোতলটির কথাও মনে রেখ, ক্যালেন্ডারের পাতা ক্রমশ বিবর্ণ হলে, ক্রমশ নতুন নায়িকার সঙ্গে, পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি।

পাতা ঝরার সময় পাতা, স্যালাইন ড্রপ, বৃষ্টিতে বৃষ্টি সব পড়ে ; বর্ণমালা আমার কিছুতেই পড়ে না। সাদা থেকে যায় পাতা। কলম টুথপিকের মত পড়ে আছে। আর ২১ শে ফেব্রুয়ারি দেখি লাল রঙে ফুটে উঠেছে অ্যানিমিক ক্যালেন্ডারের পাতাটায়, কেবল।